সর্বত্র নিরাপত্তা বেষ্টনী ও প্রবল ধর্মীয় উৎসাহ উদ্দীপনা আর আনুষ্ঠানিক পূজা অর্চনার মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইলে শুরু হয়েছে শারদীয় দুর্গোৎসব। মহালয়ার মধ্য দিয়ে এ দুর্গোৎসবের গণনা সনাতন ধর্মশাস্ত্রে শুরু হলেও ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়েই শুরু হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজোর আনুষ্ঠানিকতা। যদিও সনাতন শাস্ত্র মতে শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়েই দুর্গাপূজার দিন গণনা শুরু হয়। এবার দেবী দুর্গার আগমন হবে ঘটকে চড়ে আর প্রস্থান করবেন দোলায় চড়ে বলে বিশ্বাস এ ধর্মাবলম্বীদের। দেবীর চক্ষুদান সম্পন্ন হওয়াসহ গত ১২ অক্টোবর সোমবারই মহালয়া সম্পন্নের মধ্য দিয়ে মর্ত্যলোকে পা রেখেছেন দেবী দুর্গা। শরৎকালে দুর্গাপূজার আয়োজন হয় বলেই এই পূজার নামকরণ হয়েছে শারদীয় দুর্গাৎসব। শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে সীতাকে উদ্ধার করতে যাওয়ার আগে অকালে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন বলে এ পূজকে অকালবোধনও বলা হয়। টাঙ্গাইলের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসবটি পালনে যেমন রয়েছে দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রম, তেমনই রয়েছে উল্লেখযোগ্যতা। এ দুর্গাপূজাকে ঘিরে ৪০ লাখ মানুষের ঘণ বসতিপূর্ণ এ জেলার মানুষে মানুষে সম্পৃক্ততায় যেমন রয়েছে অভিন্ন মানসিকতা, তেমনি রয়েছে সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধনের এক দৃষ্টান্ত। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ে রয়েছে এ উৎসব পালনে একই উৎসাহ ও উদ্দীপনা।ধর্ম ও বর্ণ ভুলে এ দুর্গাপূজাতে সচেষ্টতা ও নিরাপত্তায় বৃহৎ এ জেলার দুটি জাতিরই রয়েছে সর্বাধিক সতর্কতা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই বড় উৎসব দুর্গাপূজোর প্রতিমা নির্মাণকারী শিল্পীদের বলা হয় দেউরি। এই দেউরি সম্প্রদায় তাদের মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজিয়ে তুলছেন প্রতিমাকে। প্রতিমার গায়ে শেষ তুলির পরশ বুলিয়ে অপরূপ সাজে সাজিয়ে তুলেছেন। প্রতিমা ও মণ্ডপের সাজ সজ্জার কাজ সম্পন্নের ব্যস্ততা কাটিয়ে উঠে এখন উৎসব সম্পন্ন করতে ব্যস্ত পূজা উদযাপনকারী আয়োজকরা।পূজার মণ্ডপগুলোতে ‘মা’ দুর্গার আগমন ঘটেছে। এরই মধ্য দিয়ে সকল সনাতন ধর্মাবলম্বী ‘মা’ দুর্গার আগমনের পথ চেয়ে আধীর আগ্রহে বসে থাকার সমাপ্তি ঘটেছে। দিন পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর, এমন করে পেরিয়ে যায় জীবনের ক্ষণ, বদলে যায় সময়, বদলায় চিরচেনা পরিবেশ আর সমারোহ ঘটে নতুনের। এরই ধারাবাহিকতায় আনন্দের পূর্ব আগমনী বার্তা ও প্রাণের স্পন্দনে স্পন্দিত করতে এসেছে সনাতন সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় এই শারদীয় দূর্গােৎসব। চারিদিকে কাশ ফুলের উপস্থিতিই যেন জানিয়ে দিচ্ছে `মা` দুর্গার আগমন বার্তা। সনাতন শাস্ত্র মতে এবার তাদের `মা` নৌকায় মর্ত্যলোকে আসবেন এবং দোলায় চড়ে আবার স্বামী মহাদেবের বাড়ি প্রস্থান করবেন। দোলায় গমনের ফলে দেশে শষ্য ফলে পূর্ণ হবে বলেও বিশ্বাস রয়েছে এই ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় জুড়ে। টাঙ্গাইল বড় কালিবাড়ীর মুক্তি সেন নামের এক প্রার্থণাকারী জাগো নিউজকে জানান, মঙ্গলময়ী মা যেন সবাইকে কৃপা করেন। এ বছর মা আসবেন ঘোটকে চড়ে আর যাবেন দোলায় চড়ে। মা যেন আমদের পূজা অর্চনা গ্রহণ করেন। আমাদের মঙ্গল করেন এই প্রার্থনাই তার। আগামী ১৯ অক্টোবর থেকে ষষ্ঠীপুজার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার শুরু হবে। মূলত শুভ মহালয়া থেকেই দুর্গাপূজোর আগমন ধ্বনি শোনেন এ ধর্মাবলম্বীরা।টাঙ্গাইলের বিসিক শিল্পনগরী তারটিয়া পাল-পাড়াস্থ দেউরি অর্থাৎ প্রতিমা নির্মাণ শিল্পী দুলাল পাল জাগো নিউজকে জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ তিনি প্রতিমা নির্মাণ করে আসছেন। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার প্রতিমা নির্মাণের চাপ বেশি। এবার তিনি সাতটি প্রতিমা নির্মাণের কাজ পেয়েছেন। এর মধ্যে প্যারাডাইস পাড়াস্থ গোডাউন এলাকার মণ্ডপের প্রতিমা নির্মাণে ষাট হাজারসহ আরো তিনটি করেছেন পয়ষট্টি, পঞ্চান্ন ও পঞ্চাশ হাজার টাকায়। এছাড়া ব্যক্তিগত তিনটি প্রতিমা নির্মাণে একটিতে পয়ত্রিশ, একটি ৩২ ও একটি পঁচিশ হাজার টাকা মজুরি নিয়েছেন। এ প্রতিমা নির্মাণ কাজে তাদের সময় লেগেছে ১০ থেকে ১৫ দিন। তার দলে কাজ করে নিজেসহ মোট চারজন শ্রমিক।বেতকা পূজা সংসদের সভাপতি সুব্রত সেন ও সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার দাস ছানার দেয়া সাক্ষাৎকারে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের অন্যতম বড় পূজাগুলোর মধ্যে এই পূজা মণ্ডপের উল্লেখযোগ্যতা রয়েছে দীর্ঘদিনের। প্রতিবছরই এখানে বড় পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সকলেই এ এলাকার পূজা এবং প্রতিমা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে থাকেন। তিনি বলেন, প্রতিবছর চারদিন পূজা হলেও এবারে এই উৎসব হবে তিন দিন। এরপরও তারা অতীতের পূজার প্রস্তুতি ও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাচ্ছেন। এসময় তিনি বিশেষভাবে আরও জানিয়েছেন, পূজা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সকলের সম্মিলিত সাহায্যের প্রয়োজন, পূজার সময় দেশের সকল পূজা মণ্ডপের মতো বিশেষ নিরাপত্তা দিতে টাঙ্গাইলের প্রশাসনও বিশেষ নজর দেবেন বলে তিনি আশা করেন। নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপনসহ সকল প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর দিকেই বিশেষ নজর রাখবেন। টাঙ্গাইল পূজা উদযাপন কমিটি সূত্রে জানা গেছে, গতবারের তুলনায় এবার দেশব্যাপী পুজা মণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় সাড়ে সাত লক্ষাধিক বসতিপূর্ণ সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের এ বছর জেলায় ১ হাজার ১১৪টি মণ্ডপে শারদীয় দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে ধনবাড়ী উপজেলায় ২৯টি, মধুপুর উপজেলায় ৪৯টি, ঘাটাইল উপজেলায় ৭৪টি, কালিহাতী উপজেলায় ১৬২টি, সদর উপজেলায় ১৮৪টি, দেলদুয়ার উপজেলায় ১০৫টি, নাগরপুর উপজেলায় ১২৬টি, মির্জাপুর উপজেলায় ২৩৩টি, সখীপুর উপজেলায় ৩১টি, বাসাইল উপজেলায় ৪২টি, ভূঞাপুর উপজেলায় ৩১টি এবং গোপালপুর উপজেলায় ৪৮টি পূজা মণ্ডপ হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গতবার ১৭১টি পূজো মণ্ডপ হয়েছিলো। এবার এ পূজো মণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হচ্ছে ১৮০টি। এর মধ্যে সার্বজনীন পূজা মণ্ডপের সংখ্যা ১৫৫ ও ব্যক্তিগত ২৫টি।এসব পূজা মণ্ডপসহ পুরো জেলায় নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। যে কোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ডিবি, সিআইডি পুলিশসহ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানও (র্যাব) মাঠে কাজ করবে।এমজেড/পিআর
Advertisement