বিশ্বখ্যাত কলামিস্ট নোয়াম চমস্কি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসেও যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাস প্রতিরোধে উন্নতির লক্ষ্যে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অভিযোগ করেছেন করোনারোধে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপ পুরোটাই বিশৃঙ্খল। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা এখন হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেছে। হোয়াইট হাউসের স্টাফদের মাঝে করোনা ছড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন কিনা প্রতিদিন তা পরীক্ষা করছেন।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং তার অনেক স্টাফ হোয়াইট হাউসে থাকেন। তার অফিস হোয়াইট হাউসে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট শাসনতন্ত্র অনুসারে প্রচুর নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। মন্ত্রিসভার সদস্যদের তিনি নিয়োগ দেন তবে সংসদ দ্বারা অনুমোদন নিতে হয়। তাদের বরখাস্তও করেন প্রেসিডেন্ট। এভাবেই হোয়াইট হাউস কোলাহলময় হয়ে আছে। সুতরাং হোয়াইট হাউস প্রেসিডেন্টের নির্জন নিবাস নয়। ১৩২টি রুম আর ৩৫টি বাথরুম রয়েছে। বুঝতে পারেন কত কোলাহল রয়েছে সেখানে। নোয়াম চমস্কি এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তা শতভাগ সত্য।
কোভিড-১৯ মহামারিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অদক্ষভাবে হ্যান্ডলিং শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু এবং ধ্বংসকে তীব্র করে তুলছে না, এটি সংকট মোকাবিলায় বিশ্ববাসীর প্রচেষ্টাকেও পঙ্গু করছে। এর মারাত্মক মূল্য দিতে হতে পারে বিশ্ববাসীকে। বিশ্বব্যাপী যখন কোনো সংকট দেখা দেয় তখন আমেরিকার নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে ওঠে। এইডস নির্মূলের জন্য President’s Emergency Plan for Aids Relief (Pepfar) অথবা ২০১৪ সালে ইবোলা প্রাদুর্ভাবের মোকাবিলার মতো, বিশ্বের মারাত্মক সব স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় আমেরিকা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে।
করোনা মহামারিটি এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি। আমেরিকা ভিয়েতনাম যুদ্ধের শুরু থেকেই তার সমস্ত সামরিক সংঘাতে যত লোক হারিয়েছে, কোভিড-১৯ এ হারিয়েছে তার চেয়ে বেশি লোককে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা ৮৪ হাজারের বেশি আর আক্রান্ত ১৪ লাখ ৩০ হাজার।
Advertisement
করোনার প্রকোপে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষের জীবন যাবে এবং বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন সংকট নাকি সবে শুরু হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহামারি থেকে বেরিয়ে আসার পথটি যেমন অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে তেমনি অর্থনৈতিক বিপর্যয় বিশাল আকার ধারণ করছে। তাই মহামারিকে পরাস্ত করতে বিশ্বব্যাপী একটি সম্মিলিত সফল প্রচেষ্টার জন্য আমেরিকার শক্তিশালী ভূমিকা প্রয়োজন।
অবশ্য পরিবর্তে, ট্রাম্প সংকট মোকাবিলা আরও কঠিন করে তুলছেন। ট্রাম্প মনে হয় এটা বুঝতে চাচ্ছেন না, করোনা মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ হচ্ছে কোনো একটি দেশ থেকে করোনা নির্মূল করা নয়, বিশ্বের সর্বত্র এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত ভ্যাকসিন না থাকলে ভাইরাসটি দেশ-বিদেশে চক্র চালিয়ে যেতে থাকবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি যতটা খারাপ হবে, অন্য দেশগুলোতে এর চেয়েও খারাপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। জাতিসংঘ সম্প্রতি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের জন্য তাৎক্ষণিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার যে মূল্যায়ন করেছিল তা তিনগুণ বাড়িয়েছে এবং বলেছে যে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য ট্রিলিয়ন-ডলার উদ্ধার প্যাকেজ প্রয়োজন হবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অনুসারে অভাবনীয় পরিমাণ লোক এই ভাইরাসে মারা যাবে, দুর্ভিক্ষ ডেকে আনবে এবং এমন অর্থনৈতিক মহামন্দা আসবে যে যার ফলে আরও অসংখ্য লোকের প্রাণহানি ঘটবে।
সাধারণত আমেরিকা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মহামারি মোকাবিলায় সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এর প্রয়োজনয়িতাই বোধ করছে না। অতীতে সংকটকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উন্নত দেশগুলো একত্র হয়ে সমাধানের উপায় খুঁজত; এবার, ট্রাম্প প্রশাসন জি-২০ কে পদক্ষেপ নিতে বাধা দিয়েছে।
আগামী ৩ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। করোনার দুর্যোগকে ট্রাম্প তার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সিঁড়ি হিসেবে তৈরির চেষ্টা করছেন। দেশের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্ব বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। অথচ অন্যান্য প্রেসিডেন্টের সময় আমেরিকানরা বিভাজনের সংস্কৃতি এবং অন্যকে শত্রু হিসেবে দেখার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু ট্রাম্পের সময়ে এসবই জনজীবনে বড় আকার ধারণ করেছে। অথচ এমন সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লালন করা আমেরিকার সংহতির জন্য বিপদজনক।
Advertisement
শুধু উত্তর-দক্ষিণের বিভাজন আমেরিকাকে গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন করেছিল। লিংকনের মতো দৃঢ়চেতা প্রেসিডেন্ট না হলে তখনই আমেরিকা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যেত। বহু জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে আমেরিকা গঠিত। তারমধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান আর ইউরোপ থেকে আগত জনগোষ্ঠী বেশি। আরও বহু জনগোষ্ঠী আছে। ল্যাটিন আমেরিকানদের সংখ্যাও কম নয়। বিশ্বের এমন কোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নেই যারা আমেরিকার মহাজাতি গঠনের শামিল হয়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রথম ব্যক্তি যিনি বর্ণবিদ্বেষ ছড়িয়ে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। অথচ আমেরিকার প্রতিটি প্রেসিডেন্ট গত দুইশ ৬০/৭০ বছর বর্ণবিদ্বেষ পরিহার করে চলছেন কারণ সবাই সচেতনভাবে সজাগ ছিলেন যে আমেরিকার সংহতির দুর্বলতম জায়গা হচ্ছে এটাই।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনাদুর্যোগে তার নির্বাচিত হওয়ার মওকা আর সুযোগের তালাশে থাকায় করোনা প্রতিরোধের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আবার তার নির্বাচনের মওকার কোনো সুযোগ সৃষ্টিও হয়নি। মাঝখানে মার্কিনীদের দুর্ভোগ বেড়েছে। এই এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেকারের হার ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ অথচ তার পূর্বে ছিল তিন শতাংশ। এখন গত চার মাসে দুই কোটির বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। দেশটি ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর এতটা খারাপ সমযয়ের সম্মুখীন হয়নি।
করোনা দূর হতে যদি আরও বিলম্বিত হয় তবে আমেরিকার অবস্থা আরও খারাপ হবে। অনেকে বলছেন এমনকি খাদ্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে অথচ যুক্তরাষ্ট্র এমন এক রাষ্ট্র কৃষকের পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য বহুবার উদ্বৃত্ত গম তারা সাগরে ফেলে দিয়েছে। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যদি খাদ্য সমস্যা দেখা দেয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহলে বলতে হবে ট্রাম্প প্রশাসন পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এতে কারও আত্মপ্রসাদ লাভের কিছু নেই।
মার্কিন অর্থনীতি ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতি। এই অর্থনীতি যদি দিক হারা হয়ে যায় তবে বিশ্ব অর্থনীতিরও দুর্ভোগ কম পোহাতে হবে না। অর্থনীতির মন্দা থেকে বাঁচার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বহু অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্রকল্প ঘোষণা করেছে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে যা অগোছালো হয়ে গেছে তা গোছানো কখনো সম্ভব হবে না।
তিন নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার জন্য নির্ধারিত। ডেমোক্রেটরা প্রাক্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে তাদের মনোনয়ন দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জো বাইডেন শক্ত, অভিজ্ঞ লোক। জনমত জরিপে তিনি এগিয়ে আছেন। তবে আদৌ নির্বাচন হয় কিনা তা নিয়েও সংশয় আছে। করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ আকার ধারণ করলে নির্বাচন হয়তো পেছাতে হতে পারে। তবে দেশ যেভাবে দিকভ্রান্ত অবস্থায় রয়েছে তাতে ট্রাম্পের পক্ষে পুনর্নির্বাচিত হওয়া কঠিন হবে। ট্রাম্প হয়তো বর্ণবৈষম্যের উস্কানি দেবেন কিন্তু তা আজকের পরিস্থিতিতে কার্যকর হয় কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
নির্বাচনে কারচুপির শুধু যে অনুন্নত বিশ্বের হয় তা নয়। উন্নত বিশ্বেও হয় এবং উন্নত বিশ্বে আমেরিকার নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। ডেমোক্রেটরা সতর্ক না হলে ট্রাম্প নির্বাচনে কারচুপি করতেও দ্বিধা করবে না কারণ তার নৈতিক চরিত্র খুবই দুর্বল।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/বিএ