ভ্রমণ

কবি নজরুলের তীর্থভূমি চুরুলিয়া

আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বর্ধমানের আসানসোলের চুরুলিয়ায় তার জন্মভিটা। যা ‘কবিতীথর্’ নামে পরিচিত। একটু দুর্গম ও কলকাতা থেকে দূরে বলে সেখানে যাওয়া লোকের সংখ্যা অনেক কম! বর্ধমান পার হয়ে রানীগঞ্জের মধ্যদিয়ে আসানসোল হয়ে চুরুলিয়া যাওয়া কম রোমাঞ্চকর নয়। সারি সারি কয়লা-পাহাড়ের মধ্যদিয়ে ট্রেন ভ্রমণ কম মজার নয়! উঁচু উঁচু কয়লার পাহাড় বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। আবার বাসেও কলকাতা থেকে বর্ধমান হয়ে আসানসোল যাওয়া যায়। আসানসোল রেল স্টেশন অত্যন্ত মনোরম ও ব্যস্ত।

Advertisement

ট্রেনে বর্ধমান পার হলেই ক্রমেই ধুসর শান্তিনিকেতনের পথ। লালমাটি পেরিয়ে বোলপুরের শান্তিনিকেতন। আর রানীগঞ্জের কালোপাহাড়ের মধ্যদিয়ে আসানসোল। হাওড়া থেকে ট্রেনে বর্ধমান। তারপর কবিগুরু ট্রেনে শান্তিনিকেতন। শান্তিনিকেতন দেখে পরের দিন বর্ধমানে আসলাম। উদ্দেশ্য ট্রেনে আসানসোল যাওয়া। শান্তিনিকেতন থেকে পানাগড়-রানীগঞ্জ হয়ে আসানসোল যাওয়া যায়। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ। আর ট্রেন জার্নি আরামদায়ক। তাই বেছে নিলাম ট্রেনের পথ।

অনেক ট্রেন যায় বর্ধমান থেকে আসানসোলের পথে। ১০৩ কিমির ট্রেন ভ্রমণ রোমাঞ্চ জাগায়! সকালের দিকে ট্রেন ছুটে চলল আসানসোলের দিকে। কিছুদূর যেতেই কালো কালো উঁচু-নিচু পাহাড়। এ কালোপাহাড়ের ভেতর দিয়ে আমাদের ট্রেন ছুটে চলল। কালো খোয়া দিয়ে তৈরি ট্রেনের দু’ধার। কয়লার উঁচু পাহাড়! পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম কয়লাখনি আর কয়লা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ছুটে চলছি আমরা। শ্রমিকদের কাজ আর ব্যস্ত শহর অন্ডাল ও রানীগঞ্জ পেরিয়ে সোয়া দু-ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম আসানসোল।

আসানসোল হয়ে চুরুলিয়ায় যেতে আরও রোমাঞ্চ হবে! আসল মজা এ পথেই! আসানসোল থেকে চুরুলিয়া যাওয়ার পথে বাসগুলো অজয় ঘাট পর্যন্ত যায়। চুরুলিয়া গ্রামে ঢুকতেই কবির ম্যুরাল দেখা যাবে। অজয় ঘাটের একটু আগেই চুরুলিয়ার ছোট্ট একটি বাজার। চৌরাস্তার ডানদিকের সরু ও ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। দু’পাশেই মাটির ঘর। বেশিরভাগই শন বা বিচালির চাল বা ছাদ। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় খেলা করে। যানবাহনের ব্যস্ততা নেই। ‘কবিতীর্থে’ পৌঁছে যাচ্ছি অজান্তেই।

Advertisement

নজরুল একাডেমী: অজয় নদী দিয়ে ঘেরা গ্রাম চুরুলিয়া শান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে। তবে ‘কবিতীর্থ’ অবহেলায় পড়ে আছে। কয়েক বছর সরকার একটু নজর দিলেও তা অপ্রতুল! কবিতীর্থ বা নজরুলের বাড়ি এখন ‘নজরুল একাডেমী’। কবির জীবনের বাঁক নেওয়া বিভিন্ন ঘটনার ইতিহাস সম্বলিত বই, ম্যাগাজিন ও পেপার কাটিং মিউজিয়ামে স্থান পেয়েছে। ছোট্ট বাড়িটির নিচতলায় নজরুল একাডেমী ও সংগ্রহশালা। এখানে নজরুল ও তার সন্তানদের ব্যবহৃত পোশাক, সংগীত যন্ত্র, পুরাতন ম্যাগাজিন, পেপার কাটিং, কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র, প্রমীলা দেবীর ব্যবহৃত খাট ও বিভিন্ন ছবি পর্যটকদের বাড়তি কৌতূহল মেটাবে!

নজরুল একাডেমীতে গবেষণার জন্য কবির বিভিন্ন বই, সম্পাদিত ম্যাগাজিন রয়েছে। পরিচালনা করার জন্য একটি কমিটিও রয়েছে। সাদা কালো নানা আলোকচিত্র, পাণ্ডুলিপি ও চিঠিপত্র সযত্নে রাখা আছে। আছে বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত কবির বিভিন্ন পুরস্কার, পদকের সম্ভারের মধ্যে জগত্তারিণী পদক ও মানপত্র, পদ্মভূষণ পদক ও মানপত্র। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবির মৃত্যু ও পরবর্তী শবযাত্রার আলোকচিত্র। রয়েছে নানা ধরনের বস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র, ব্যবহারিক জিনিসপত্র, গ্রামোফোন, তানপুরা ইত্যাদি। ব্যবহৃত জিনিসগুলোর অধিকাংশ দিয়েছেন কবির কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী। সংগ্রহশালার কয়েকটি শো-কেস দিয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ। এসব তথ্য দিলেন নজরুল একাডেমীর সদস্য নকুল মাহাত।

সময়সূচি ও প্রবেশ ফি: নজরুল একাডেমী প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা, দুপুর ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এটি একটি কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। প্রবেশ ফি ৫ রুপি। প্রবেশ ফিকে অনুদান হিসেবেই বিবেচনা করছে কর্তৃপক্ষ।

টাউন লাইব্রেরি: পাশেই টাউন লাইব্রেরি। কবির আঁতুরঘরের সাথেই একাডেমী ও এ লাইব্রেরি। ১৯৬২ সালে নজরুল একাডেমী সংগ্রহশালা তৈরি করা হয় বলে জানা যায়। পরে সরকার ১৯৮২ সালে ‘টাউন লাইব্রেরি’ হিসেবে মর্যাদা দেয়। লাইব্রেরিয়ান কাজী পরিবারের গোলাম কিবরিয়া এ তথ্য জানান। এখানে বিভিন্ন শ্রেণির বইপত্র, গবেষণাপত্র, জার্নাল রয়েছে। ফটোকপির ব্যবস্থাও আছে। শিক্ষার্থী-পাঠকরা বই পড়তে পারবেন। বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।

Advertisement

কবিতীর্থের স্মৃতি: কাছেই নজরুলের শৈশবের মসজিদ, পুকুর ও পাঠশালা। এ ছাড়া সমাধিস্থল। এখানে রয়েছে কবির পাথরের পূর্ণাবয়ব মূর্তি। কবি ও কবিপত্নী প্রমিলা দেবীর সমাধি রয়েছে পাশাপাশি। কবির কবরের মাটি নেওয়া হয়েছে ঢাকা থেকে। সমাধি উদ্যানের পাথরের স্মৃতিফলকটি স্থাপিত হয় ১৯৯৮ সালে। মূর্তিটি স্থাপন করেছে স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড। স্মৃতিসৌধের ফলকটিতে রয়েছে অগ্নিবীণার ছবি। এ ছাড়াও কাজী পরিবারের অন্যদের কবর ও স্মৃতিফলক রয়েছে। নজরুল একাডেমীর দুই কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যেই স্থাপনাগুলো দেখা যাবে। ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কবির মক্তব এখন ‘নজরুল বিদ্যাপীঠ’। আরও আছে নজরুল কলেজ।

একেবারেই ছোটগ্রাম চুরুলিয়া। কবির জন্মদিন উপলক্ষে কবিতীর্থে সাত দিনব্যাপী মেলা হয়। নজরুলের ছেলে সব্যসাচী কবির মৃত্যুর পর কবরের মাটি নিয়ে প্রতীকী কবরস্থান করেন। তার পাশেই কবিপত্নী প্রমীলা দেবীর কবর! ১৯৭৮ সাল থেকে জাঁকজমক অনুষ্ঠান করে কবির ছোট ভাইয়ের পরিবার। তবে সরকারি অনুদান খুব কমই থাকে। প্রশ্ন জাগবে আর উত্তর পাবেন একইসঙ্গে! কবি কোথায় থাকতেন, কোথায় পড়তেন এবং স্কুলের আঙিনা! মসজিদের সামনেই পুকুর যেন কালের সাক্ষী! এখানেই কবি সাঁতার শিখেছেন, গোসল করেছেন! আরও কত কী!

অজয় ঘাট ও সর্ষেতলি: চুরুলিয়া থেকে ৩-৪ কিমি গেলেই অজয় নদীর ঘাট। আসানসোল থেকে ছেড়ে আসা বাসগুলো অজয় ঘাট পর্যন্ত যায়। অজয় নদের ধারে ছোট্ট একটি জঙ্গল। নাম সর্ষেতলি। নানা ধরনের বুনো ফুলের গাছ আর পাখির ডাক মনকে উদাস করে দেয়। দারুণ নিরিবিলি জায়গা। আমি যেদিন গিয়েছিলাম; সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। ভুল করেই চুরুলিয়া বাজার পেরিয়ে অজয় ঘাট পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। বাসের কন্ডাক্টর বললেন, ‘ফেরত যাওয়ার পথে চুরুলিয়া বাজারে নামিয়ে দেব।’ ভুল হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, চুরুলিয়া ছোট্ট বাজার। বিশ্বাস হয়নি কয়েকটা দোকানের এ বাজারে নামতে হবে। সামনে হয়তো বড় বাজার আছে। নজরুলের চুরুলিয়া বলে কথা!

কোথায় থাকবেন: এখানে থাকা-খাওয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই। অনলাইনে বুকিং দিয়ে চুরুলিয়া ‘নজরুল যুব ভবনে’ থাকা যেতে পারে। কবির জন্মদিন উপলক্ষে মেলায় আগত অতিথির একটি অংশ এখানে থাকেন। তবে আসানসোলে ইচ্ছেমতো দাম ও মানে থাকতে পারবেন।

কীভবে যাবেন: কলকাতা-হাওড়া থেকে উত্তরপ্রদেশ-দিল্লিগামী যেকোনো ট্রেনে আসানসোল যাওয়া যাবে। অথবা লোকাল বা গোহাটি-নিউ জলপাইগুড়িগামী ট্রেনে বর্ধমানে নেমে লোকাল ট্রেনে আসানসোল যাওয়া যাবে। অথবা বোলপুরের শান্তিনিকেতনে আগে প্রোগ্রাম থাকলে, শান্তিনিকেতন থেকে বাসে রানীগঞ্জ হয়ে আসানসোল যাওয়া যাবে। তার আগে আপনাকে যেতে হবে কলকাতায়। এক্ষেত্রে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা বা যশোরের বেনাপোল পোর্ট ব্যবহার করলে সুবিধা হবে। গেদে বা বনগাঁ থেকে শিয়ালদহগামী অনেক ট্রেন পাবেন। অথবা বিমানেও কলকাতা যেতে পারেন।

লেখক: উপপরিচালক (বিআরডিবি), কুষ্টিয়া।

এসইউ/পিআর