চুলা জ্বলছে না, কেবল ধুয়া উঠছে। ফুঁ দিয়ে আগুন ধরানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধা। এক চুলায় তরকারি, অন্যটিতে ভাত। উৎকট গন্ধ বেরিয়ে আসছে। সবগুলোই খাবার অযোগ্য। উসকো খুসকো চুল। মলিন গায়ে ময়লা ও ছেঁড়া জামাকাপড়। ময়লার স্তূপ চারদিকে। দেখে বুঝতে বাকি রইলো না তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন।
Advertisement
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারের পূর্বপ্রান্তে রাস্তার পাশেই খোলা আকাশের নিচে ঘর ওই বৃদ্ধার। এটাই তার পৃথিবী। কথার বলার চেষ্টা করেও সাড়া মিললো না। তিনি কেবল আনমনেই রান্না করে চললেন। বিকেল ৫টা নাগাদ তার সামনে এসে থামলো জেলা পুলিশের পিকআপ ভ্যান। হাতে খাবারের প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে এলেন কনস্টেবল আবদুল হাকিম। বৃদ্ধার হাতে তুলে দিলেন খাবারের প্যাকেট। হাসিমুখে খাবার নিলেন বৃদ্ধা।
কনস্টেবল আবদুল হাকিম জানান, গত এক মাস ধরে প্রতিদিন একই সময় এসে তিনি ওই বৃদ্ধাকে খাবার দিয়ে যান। কখনও ওই বৃদ্ধা কথা বলেননি। খাবার নিয়ে দাঁড়ালেই হাত বাড়ান। যখনই তিনি এসেছেন মানসিক ভারসাম্যহীন ওই বৃদ্ধাকে কিছু না কিছু রান্না করতে দেখেছেন। অনেকটা শিশুদের পুতুল খেলার মতই। তবে যা রাঁধেন তা একেবারেই খাবার অযোগ্য। পথে-ঘাটে, দোকানে চেয়ে যা পান তা দিয়েই ক্ষুধা নিবারণ করেন। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে রাস্তায় লোকজন নেই, দোকানপাটও বন্ধ। ফলে খাবারও জুটছিলো না তার। প্রতিদিন নিয়ম করে অভুক্ত এই বৃদ্ধার হাতে খাবার পৌঁছে দেন কনস্টেবল আবদুল হাকিম ও আবদুল কাদের।
কেবল এই অসহায় বৃদ্ধাই নন জেলা পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লার পাঠানো খাবার এই দুজন পৌঁছে দেন নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থানকারী ভবঘুরে, প্রতিবন্ধী এবং ভিক্ষুকদের হাতে। এক মাসের বেশি সময় ধরে তারা এই খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। সপ্তাহে সাতদিনই বিকেল ৪টার দিকে জেলা পুলিশ সুপারের দফতর থেকে ছাড়ে খাবার বহনকারী গাড়ি।
Advertisement
এ কার্যক্রমে ঝড়-বৃষ্টি কিংবা কোনো প্রতিকূলতায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এখনও। নগরীর লক্ষ্মীপুর, রেলগেট, রেলওয়ে স্টেশন, তালাইমারি, বিনোদপুর, সাহেববাজর, নিউ মার্কেট, রাজশাহী কলেজ হোস্টেল এলাকা এমনকি পদ্মাপাড় ঘুরে অসহায় এসব লোকজনের হাতে খাবার পৌঁছে দেন এই দুই কনস্টেবল। খাবারের তালিকায় থাকে ভাতের সঙ্গে কোনো দিন মাছ, কোনো দিন মাংস, আবার কোনো দিন ডিম। কখনও বা সবজি থাকে। সঙ্গে থাকে পানির বোতল।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুলিশ সুপারের পাঠানো খাবারের আশায় বসে রয়েছেন অভুক্ত লোকজন। রেলওয়ে স্টেশনের সামনের ফুটপাত ধরে লাঠিতে ভর দিয়ে সামনে এগুচ্ছিলেন ষাটোর্ধ্ব কাবিল মণ্ডল। জেলার চারঘাটের সলুয়া এলাকা থেকে এসেছেন তিনি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছয়জনের সংসার তার।
তিনি জানান, তার ছেলেরা রিকশা চালান। কিন্তু লকডাউনে রিকশা বন্ধ। আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় বাড়িতে খাবারও নেই। লকডাউন শুরুর দিকে ৫ কেজি চাল ও ২ কেজি আটা ত্রাণ সহায়তা পেয়েছিলেন।
সেগুলো অনেক আগেই শেষ। ছেলেরা যে যার মত রোজগারের চিন্তায় আছে। এই দুর্যোগে তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেননি। অভুক্ত পরিবারের জন্য খাবার যোগাতে বের হয়েছেন রাস্তায়।
Advertisement
এই বৃদ্ধের ভাষ্য, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। খাবার চাইলেও সাড়া মিলছে না। অভুক্ত অবস্থায় পথে পথে ঘুরি। কিন্তু পুলিশের খাবারই একমাত্র ভরসা এখন। আমি নিয়মিতই এই খাবার পাই।
আরেকটু এগিয়ে নগরীর রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে অপেক্ষমান পাওয়া গেলো ২০ জনের মতো প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক ও ভাসমান লোকজনকে। সবার ভাষ্য একই, তারা বসে আছেন খাবারের আশায়।
তারা জানান, বেলা ৩টার পর থেকেই এখানে জড়ো হতে থাকে লোকজন। সাড়ে ৪টা নাগাদ এখানে খাবার নিয়ে আসে পুলিশের গাড়ি। এর বাইরেও অনেকেই খাবার এনে দিয়ে যান তাদের। কেউ কেউ একাধিক প্যাকেট খাবার নিয়ে ঘরে ফেরেন।
লকড়াউনের কারণে বন্ধ রাজশাহীর শিরোইল বাসস্ট্যান্ড। সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে থাকলেও নেই মানুষের হাঁকডাক। বাসস্ট্যান্ডের টিকেট কাউন্টারের সামনেই অপকৃতস্থ অবস্থায় পাওয়া গেলো এক মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধকে।
পরিবহন শ্রমিকরা জানান, তারাই এই বৃদ্ধের খাবার যোগান দিতেন। কিন্তু এখন বাস বন্ধ। আয়-রোজগার না থাকায় পরিবার নিয়ে নিজেইরাই আছেন চরম কষ্টে। তবে মাসখানেক ধরে পুলিশের দেয়া খাবার খাচ্ছেন এই বৃদ্ধ। প্রতিদিন পুলিশ সদস্যরা এসে তাকে খাবার দিয়ে যান।
জেলা পুলিশের এই মানবিক কাজ এরই মধ্যে নগরবাসীর ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। ডাক্তার-নার্সদের মতো করোনাযুদ্ধের সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে লড়াই চালিয়ে যাবার পরও অভুক্ত মানুষের কথা ভোলেনি পুলিশ। এ রকম কাজ এর আগে কখনও চোখে পড়েনি নগরবাসীর। এটি অনন্য নজির হয়ে রইবে।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখায়ের আলম বলেন, জেলা পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহর নির্দেশনায় পুলিশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার যে দায়িত্ব তার পাশাপাশি আমরা এই মানবিক কাজ করছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলবে। এই দুর্যোগে সবাইকে মানবিক কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ জানান, ছিন্নমূল প্রতিবন্ধী অসহায় মানুষগুলোর খাবারের কষ্ট শুধু তারাই বোঝেন, যারা তাদের আশপাশে গিয়েছেন। আর এই করোনা পরিস্থিতিতে তারা আরও অসহায় হয়ে পড়েছেন। এসব ক্ষুধার্ত মানুষের খোঁজ রাখে না কেউ। হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় ভিক্ষার টাকায় কিনে খেতেও পারেন না তারা।
তাই আমি ব্যক্তিগত অর্থে প্রতিদিন ৫০ জন অসহায় প্রতিবন্ধীর খাবারের ব্যবস্থা করেছি। নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন আমাদের কয়েকজন সদস্য। আগামীতে ছিন্নমূল-প্রতিবন্ধী অসহায় মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়ার এই পরিধি আরও বাড়ানোর চেষ্টা করবেন বলেও জানান পুলিশ সুপার।
আরএআর/জেআইএম