দেশজুড়ে

বগুড়ায় দেড় লাখ পরিবহন শ্রমিকের মানবেতর জীবনযাপন

বগুড়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে নেয়া লকডাউনে প্রায় দেড় লাখ পরিবহন শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেড় মাস ধরে তাদের কোনো আয় রোজগার নেই। বাড়িতে বসে আলস সময় কাটছে তাদের। হাতে জমানো কিছু টাকা পয়সা ছিল তাও শেষ। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদে কী করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। জানা গেছে, সরকারি সাহায্য বলতে সবাই নয়, দু-একজন ১০ কেজি মোটা চাল পেলেও তা দিয়ে বেশিদিন সংসার চালাতে পারেননি। আগামীতে লকডাউনের মেয়াদ বাড়লে শ্রমজীবী এসব মানুষদের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যাবে। তবে বগুড়ায় সরকারি সাহায্যেরও পরিমাণ বাড়ানো অব্যাহত থাকলেও এখনও বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ তা থেকে বঞ্চিত বলে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেন।

Advertisement

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে দেশে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়।

বগুড়া পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের পরিসংখ্যান সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত এক লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ শ্রমজীবী। যারা এ সময় কর্মহীন হয়ে দুর্দশার জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের মধ্যে জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক রয়েছেন ১৩ হাজার, বাস-মিনি বাস শ্রমিক রয়েছেন ২৩ হাজার, সিএনজি ও অটোরিকশাা চালক ৭ হাজার, রিকশা ভ্যান ও ঠেলাগাড়িসহ অযান্ত্রিক সড়ক পরিবহন শ্রমিক ১৫ হাজার, হোটেল, বেকারি, ঢালাই ও লেদ শ্রমিক ১০ হাজার, দোকান ও প্রতিষ্ঠান কর্মচারি ৫ হাজার, ভাসমান শ্রমিক ১০ হাজার, ডেকোরেটর শ্রমিক এক হাজার, ফার্নিচার শ্রমিক ৩ হাজার, ইটভাটা শ্রমিক ৩০ হাজার, কুলি ৫ হাজার, নরসুন্দর (নাপিত) ২ হাজার ও মুচি ৫০০।

এর বাইরেও দর্জি শ্রমিক, গৃহনির্মাণ শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন আরও অনেকেই। এর মধ্যে শুধু ১৩ হাজার ট্রাক শ্রমিক ট্রাক চালালেও বাকি দেড় লাখ শ্রমিক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

Advertisement

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া এদের প্রায় সবাই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় তাদের পরিবারের খরচ নির্বাহ করতে হচ্ছে জমানো টাকা খরচ করে। কারও কারও ভাগ্যে যে সরকার বা বেসরকারি ত্রাণ জুটছে না, তা নয়। জুটলেও তা সীমিত শ্রমজীবী মানুষ পাচ্ছেন। বগুড়া সদর উপজেলার নামুজা এলাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক রোস্তম আলী জানান, সিএনজি চালু থাকাকালে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হতো। এখন প্রায় ৫০ দিন ধরে সিএনজি চলাচল বন্ধ। এর মধ্যে সরকার থেকে ১০ কেজি চাল ছাড়া আরও কিছু পাননি। সামনে ঈদ। কিভাবে সংসার চলবে তাই ভাবছি। দুপচাঁচিয়া উপজেলার সদরের বাসচালক বাচ্চু মিয়ার পরিবারের লোকসংখ্যা ৫ জন। তিনি সংসারের কর্তা ব্যক্তি। কিন্তু দেড় মাস ধরে গাড়ির চাকা বন্ধ। ধার দেনা করে সংসার চালাচ্ছেন কোনোমতে। শিবগঞ্জ পৌর এলাকার অর্জুনপুর মহল্লার বাসিন্দা চান্দু মিয়া। ঢাকায় কোচের সহকারী হিসেবে চাকরি করেন। ৫ সদস্যের পরিবার তার। প্রায় দেড় মাস ধরে গাড়ি বন্ধ। আয় রোজগার কিছুই নেই। মাঝে তাকে পৌরমেয়র ১০ কেজি চাল ও ২ কেজি আলু দিয়েছেন। এ দিয়েই চলছে তার সংসার। সামনে ঈদ আসছে। ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু হয়তো করতে পারবেন না। এটাই তার কষ্ট।

বগুড়া জেলা জাতীয় শ্রমিকলীগ ও জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সামছুদ্দিন শেখ হেলাল বলেন, তাদের ইউনিয়নের নিবন্ধিত শ্রমিক সংখ্যা ২১ হাজার এবং এটি বগুড়া তথা এ অঞ্চলের বৃহত্তর শ্রমিক সংগঠন। এদের অধিকাংশই নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। যাদের পক্ষে মানুষের কাছে হাত পাতা সম্ভব নয়। আবার তাদের হাতে তেমন টাকা মজুদ ও থাকে না। এ দীর্ঘ সময় গাড়ি বন্ধ থাকায় তাদের জমানো টাকা শেষ হয়ে গেছে। ফলে তাদের খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, তার সাধ্যমতো এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে অর্থ ও খাদ্য সাহায্য করেছে। কিন্তু যা দিয়েছেন তা নিতান্তই অপ্রতুল। এজন্য তিনি সরকারি সাহায্যেও জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে তার ইউনিয়নের ২১ হাজার শ্রমিকের নামের একটি তালিকা জমা দিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তালিকা পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে বলেন, মোটর শ্রমিকদের পক্ষে আলাদাভাবে কিছু করার সুযোগ তার নেই। কারণ জেলার জন্য যে ত্রাণ বরাদ্দ হয়, তা উপজেলা ও পৌরসভায় ভাগ করে দেয়া হয়। আর তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলররা নিজেরাই তালিকা তৈরি করে তারাই তা বিতরণ করেন।

Advertisement

এ প্রসঙ্গে বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভুঞা বলেন, বগুড়াসহ রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে অয়োজিত ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তিনি শ্রমিকদের এ দুঃখ দুর্দশার কথা তুলে ধরলে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, শ্রমজীবী কর্মজীবী মানুষ এভাবে দীর্ঘদিন কর্মহীন হয়ে থাকলে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়। যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছে।

এমএএস/এমএস