মতামত

লকডাউন শিথিলে সামাজিক দায় ও সচেতনতা

চারদিকে থৈ থৈ করছে পানি। মাঝখনে উঁকি দিয়েছে সামান্য ঝোপঝাড়। যতটুকু মনে পড়ছে, দৈনিক সংবাদে এই ছবিটি ছাপা হয়। শুধু একটা ক্যাপশন ছিল- ‘এখানে একটা গ্রাম ছিল’।

Advertisement

আশির দশকের কোনো একসময় বন্যা হয়েছিল দেশে। সে সময়ের উত্তরবঙ্গের চিত্র ছিল এটি। বাংলাদেশের মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের সে সময়ের এ রকম চিত্র এবং তার রিপোর্ট কিংবা প্রতিবেদন কিংবা কলাম ছিল লাখো-কোটি নিপীড়িত মানুষের প্রতিচ্ছবি। সেই মোনাজাতউদ্দিনও এখন নেই, নেই উত্তরবঙ্গের বহুল আলোচিত সেই রিপোর্টগুলো, যার একটিতে লিখেছিলেন, লোকটা মৃত্যুর পূর্বে কলা খেয়েছিল। অর্থাৎ প্রচণ্ড ক্ষুধার জ্বালায় দিগ্বিদিক হয়ে থাকা মানুষটা খালি পেটে কয়েকদিন থাকার পর কলা পেয়েছিলেন এবং এই কলাই শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারণ হয়ে গিয়েছিল। সে সময় উত্তরবঙ্গের মঙ্গা কিংবা দুর্ভিক্ষের কথা লিখতে বা বলতেও প্রতিবন্ধকতা ছিল। অর্থাৎ ক্ষুধায় মারা যাওয়া শব্দটা আজকের গুজবের পর্যায়ে পড়ে যেত।

গুজব অভিধানে নতুন কোনো শব্দ নয়। তবে গুজব নতুন মাত্রা পেয়েছে এ যুগে। প্রযুক্তিতে পৃথিবীর অভাবনীয় পরিবর্তনে এ জাতীয় শব্দগুলো নতুন মাত্রা পেয়েছে সবখানেই, সবদেশেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই যেমন ফেক নিউজ যেখানে বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ডে বিচার বিশ্লেষণ করা হয় না, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এর একটা বিবেচনাধীন মানদণ্ড তৈরি হয়ে গেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আর সে জন্য বাংলাদেশে এখন ফেক নিউজ মোটাদাগে গুজব হিসেবেই চিহ্নিত করা হচ্ছে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বড় ধরনের হাঙ্গামা তৈরি করতে ইন্ধন জুগিয়েছে বিভিন্ন সময়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া গুজব।

নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, ছেলেধরা আতঙ্ক প্রভৃতিতে এমনকি বাংলাদেশে প্রাণহানিও ঘটেছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে একজন মডেল লাইভে এসে তাকে এবং অসংখ্য মেয়ের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। এ হিসেবে গুজব অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। কিন্তু গুজবও বিচার বিশ্লেষণ করে পক্ষে হলে সংবাদ এবং বিপক্ষে গেলে গুজব ধরনের রাজনৈতিক চতুরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না আমাদের চারপাশ।

Advertisement

বাংলাদেশে ফেসবুকটাই এই এখন যেন যোগাযোগের প্রধান জায়গা করে নিয়েছে এবং বিশেষত সারা বিশ্বব্যাপী করোনার এই বিপর্যয়ে মানুষ যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই খোঁজে নিচ্ছে তাদের ঠিকানা। দিনব্যাপী ফোন, তাও হোয়াটসআপ, মেসেঞ্জার প্রভৃতি ব্যবহার করে মুখোমুখি হচ্ছি আমরা সবাই। দেখে নিচ্ছি প্রিয়জনদের, ঝালাই হচ্ছে বন্ধুত্ব। ফিরিয়ে আনছি আমারা আমাদের কৈশোর, দুরন্ত শৈশবের স্মৃতি।

এ সময়ে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই খুঁজছি আমাদের এবং সে জন্যই ‘ফেসবুক ইন্টেলেকচুয়েলদের’ (!) সংখ্যাও বেড়েছে। করোনা নিয়ে ডাক্তার, বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি যে কেউ প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে, আলোচনায়-সমালোচনায় মুখরিত করে তুলছেন এ প্লাটফর্ম। সে কারণে এ প্লাটফর্মই এখন মানুষের শেষ খবরটি পাওয়ার যেন জায়গা হয়ে গেছে। শুধু সাধারণ মানুষ না, এই করোনা সময়ে এমনকি পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত টয়লেট পরিষ্কারের ডিসইনফেকটেড (জীবাণুনাশক) দিয়ে ভেতরের ভাইরাস পরিষ্কার করার থিওরিও দিয়েছেন। কিন্তু তার দেশের মানুষ থেকে শুরু করে পৃথিবীর কোনো মানুষই এটাকে কোনো গুজব হিসেবে নেয়নি, কিংবা তাকে তোলেনি আইনের কাঠগড়ায়।

বাংলাদেশ নিয়েও দেশের জনগণের শঙ্কা আছে সারাবিশ্বের মতোই। কিন্তু সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশ নিয়ে যে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে, সে রকম অবস্থায় নেই দেশটি। চীন ইতালি স্পেন আমেরিকা এবং পরবর্তীতে ব্রিটেনের এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর এই দেশগুলোতেই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে অধিক সংখ্যক মানুষ, মৃত্যুও হয়েছে যুদ্ধে নিহত হওয়া মানুষের মতো। ইতালি ব্রিটেন আমেরিকায় আমরা প্রতিদিন স্বজন হারানোর ক্রন্দন শুনেছি, দেখেছি বাংলাদেশি কমিউনিটিতে হাহাকার। কাছের মানুষেরও মৃত্যুর খবর শোনতে হয়েছে প্রতিনিয়ত।

এ প্যান্ডামিকে তিন লক্ষের কাছাকাছি মৃত্যু সারা পৃথিবীতে। অর্থাৎ জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা নিতান্তই অল্প। রিসোর্স স্বল্পতা কিংবা চিকিৎসাসেবা পশ্চাৎপদ থাকার কারণেই করোনা টেস্টিংয়ে আছে ধীরগতি। সে জন্যই করোনায় মৃত্যুর আসল চিত্রটা হয়তো আসছে না। এ কথার অর্থ এ নয় যে, সরকার ইচ্ছে করেই আক্রান্তদের সংখ্যা প্রকাশ করছে না। এই দুর্বলতা পৃথিবীর সব জায়গায়ই লক্ষ্য করা গেছে ভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে।

Advertisement

মোট ১৫৬৯১ জন আক্রান্ত হলেও গতকাল (১১ মে) পর্যন্ত বাংলাদেশে মারা গেছেন ২৩৯ জন, যা অন্যান্য দেশের আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সাথে তুলনা করলে ভয়াবহ নয়। ব্রিটেনে মোট মৃত্যুর সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৩১ হাজার ৮৫৫। রোববার সবচেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে, তাও ২৬৯ জন অথচ বাংলাদেশে মারা গেছেন ১৪ জন। ব্রিটেন করোনা সংক্রমনের পিক টাইম (ঝুঁকিপূর্ণ সময়) পেরিয়ে এসেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে, যদিও তারা এখন প্রতিদিন এক লাখ মানুষের করোনা টেস্ট করছে। আর সে জন্যই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী দেশটাতে নতুন নির্দেশনা দিয়েছেন ১০ মে সন্ধ্যায়। এতে ইঙ্গিত আছে পার্কে যাওয়ার, ড্রাইভ করে পরিবার নিয়ে বের হওয়ার, কনস্ট্রাকশন ওয়ার্ক কিংবা পণ্য উৎপাদনের কারখানায় কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তুলে দেয়া হয়েছে।

নাগরিকদের প্রয়োজনে বাইরে বেরুবার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু দোকানপাট খোলার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু না আসলেও জুন থেকে তা-ও খোলে দেয়া হবে। আংশিকভাবে স্কুলও খুলবে জুন থেকেই। রেস্টুরেন্টে ভোজনবিলাসী হতে কিংবা পাবে মাতাল হবার নির্দেশনা আসতে হয়তো জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সরকারি কোষাগার থেকে সব দেশই প্রয়োজনীয় জোগান দিচ্ছে দেশগুলোর নাগরিকদের। কিন্তু একটা দেশ পুরোপুরি বন্ধ থাকলে অর্থনৈতিক প্রবাহ হোঁচট খায়। সে জন্য ইতালি স্পেন ইতোমধ্যে কিছুটা শিথিল হয়েছে। ব্রিটেনও এ পথেই আগাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ কি এ জায়গাটাতে আছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এমনকি সরকারি-বেসরকারি চাকরজীবীরা লকডাউনের পক্ষে থাকবেনই, কারণ তারা আতঙ্কের মাঝে থাকলেও খাবার সংকটে নেই।

অর্থ আছে তাদের, অন্তত বেঁচে থাকার অবলম্বন আছে। স্বাভাবিকভাবেই জীবন নিয়ে অধিক সচেতন এই শ্রেণি। এরা বিশ্বের খবরাখবর প্রতিদিনই নিচ্ছেন। ভয়াবহতার চিত্র তারা অনুমান করতে পারেন। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষ যারা দিন আনে দিন খায়, আয়হীন এই মানুষগুলোকে দীর্ঘদিন সরকার পোষণ করার মতো শক্তি কি রাখে? বাংলাদেশকে যদি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবেও ধরে নেই, তা-ও উত্তরটা আসবে, এ ক্ষমতা সরকারের নেই।

বাংলাদেশের এমন সময়ে উভয় সংকটেই আছে সরকার। একদিকে মধ্যবিত্ত মানুষের ঘরে থাকার আকুতি, অন্যদিকে হাইপ্রোফাইল ব্যবসায়ী যেমন গার্মেন্টস কারখানার মালিকরা কারখানা খুলে নেয়ার সুযোগ করে নিয়েছেন। মাঝারি-ছোট ব্যবসা খুলে দেবার চাপে ছিল সরকার। তা-ও অনুমতি এসেছে । ব্যবসায়ীরা মুনাফা বোঝেন, সাধারণ মানুষের মৃত্যুচিন্তা তাদের খুব একটা ভাবায় না। তবুও দেশজুড়ে আছে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নিজেও কিছুটা ঢিলে-ঢালা অবস্থানের পক্ষে। কিন্তু বাংলাদেশের আসল চিত্রটা কি লকডাউন থেকে বেরিয়ে আসার মতো অবস্থায়, সে প্রশ্নটা আছে।

ব্রিটেনের ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে নেয়ার যে ঘোষণা এসেছে, যার প্রথমদিন শুরু হচ্ছে ১১ মে থেকে, সেখানেও সামাজিক দায়বোধের কথাটা এসেছে বারবার। যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার’ নির্দেশনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কি এই অবস্থানে আছে? সামাজিক দূরত্ব কিংবা নিজস্ব স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটুকু সচেতন হয়ে উঠেছে আমাদের মানুষ, তা বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশ-র‌্যাব যেভাবে এখন নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছে, তা চলমান রাখতে হবে। সামাজিক সচেতনার বিষয়টি এখন বাংলাদেশের মানুষের অবশ্যই করণীয় বিষয়ের একটা হিসেবেই প্রাত্যহিক জীবনের অংশ করে নিতে হবে।

সামান্য অসচেতনতা কিংবা অপরিণামদর্শিতার কারণে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসা অস্বাভাবিক নয়। এ নিয়ে মানুষ আলোচনা-সমালোচনা চালাতেই পারে। ব্রিটেনে এত সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও সমালোচনা থেমে নেই। বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, এ সরকার সমস্যা বাড়ায় কিন্তু সমাধানের পথ সহজে দেখায় না। পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলতেই পারে মানুষ, কিন্তু সমালোচনাকে আমলে নিয়ে জনগণের বিপরীতে গেলে সরকারের ভালো কাজগুলোই প্রশ্নবোধক হয়ে যায়। সমালোচনাকে গুজব হিসেবে চালিয়ে দেয়ার ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ মহাদুর্যোগে রাজনৈতিক ঐক্য না হোক সহাবস্থান প্রয়োজন।

বন্যায় পানিতে যেমন একটা গ্রাম তলিয়ে যায়, কিংবা মোনাজাত উদ্দিনের সেই কলা খেয়ে মঙ্গায়-দুর্ভিক্ষে মারা যায় মানুষ, সর্বহারা হয়। কিন্তু থৈ থৈ জল একসময় নেমে গিয়ে আবারও এই গ্রামেই এসেছে শিশুদের কোলাহল। এখন মঙ্গা শব্দই নেই। জীবন স্বাভাবিক হয়, হবেই। সভ্যতা বিলীন হয়নি কোনো মহামারিতেই। আবারও জেগে উঠছে পৃথিবীর দেশগুলো। বাংলাদেশও জেগে উঠবে। সামাজিক দায়বোধ আর সামাজিক সচেতনতাই জাগিয়ে দিতে পারে এ বাংলাদেশ আবার নতুন করে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/বিএ/জেআইএম