নূরেম মাহ্পারা
Advertisement
এখন শীতের মাঝামাঝি। ছোট দিনের বেলা। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। ওদিকে কুয়াশা কেটে রোদের দেখা মিলতে মিলতে সকাল ১০টা। মেঘডুবি, এক ছোট শহরের নাম। এক রাস্তার শহর। ঠিক মাঝখান দিয়ে চলে গেছে চওড়া পাকা সড়ক। দুধারে বসতি। মেঘডুবিকে শহরের চেয়ে মহকুমা বলা ভালো। শেষ দুই প্রান্ত ছুঁয়ে গেছে বাইপাস সড়ক। ফলে শহরের আকৃতি দাঁড়িয়েছে অনেকটা ইংরেজি ডি বর্ণের মতো, এর চারপাশে সবুজ খেত- ছোট ছোট গ্রাম। আর কিছু নেই। তাই এই ছোট দিনের বেলাও দুহাতে ঠেলে পার করতে হয় এখানে। বলা যেতে পারে, মেঘডুবিতে আঠারো মাসে বছর। বেড়ানো বলতে, বছরে একবার গ্রামের বাড়ি কিংবা পাশের জেলায় আত্মীয় বাড়ি যাওয়া।
কিন্তু শহুরে বাতাস একেবারেই বয়ে যায়নি, এমন বলাও ঠিক হবে না। বাকি সব যা-ই হোক, হাতে হাতে উঠেছে স্মার্ট ফোন, ঘরে ঘরে কালার টিভি, ক্যাবল কানেকশন- এগুলোও এসেছে। সাথে এসেছে, রঙ মিলিয়ে পোশাক পরার ট্রেন্ড। নতুন মডেলের জুতা, স্যান্ডেল। এই মেঘডুবি শহরের মাঝখানে হয়েছে কফি হাউস। অবসর কাটানোর জন্য জায়গাটা মন্দ না। পাশেই মাসুমের জুতার দোকান। স্টার প্লাস, স্টার জলসার সিরিয়াল, ভারতের বাংলা সিনেমা, সালমান, শাহরুখ, ক্যাটরিনা, কারিনা- যা পরুক। ঠিক ১৫ দিনের মাথায় সেই মডেলের জুতা-স্যান্ডেল এনে দিতে পারে মাসুম। দুই ঈদ, দুর্গা পূজা, পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন আর ভ্যালেন্টাইন ডে’তে আধুনিক স্যুজ তাই একমাত্র ভরসা।
অবশ্য, মাসুমের ক্রেতারা শুধু কম বয়সী বা উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা। তাতে কী! ঈদের বাকি সাত দিন, এখন থেকেই ভিড় সরছে না। প্রায় রোজই ঢাকা থেকে আসছে নতুন নতুন মডেলের জুতা, স্যান্ডেল। বিক্রিও ভালো। মাগরিবের আজান হলে ইফতারের বিরতি, তারপরই ভিড় শুরু। দোকান বন্ধ করতে রোজই নয়টা, এমনকি সাড়ে নয়টা বেজে যাচ্ছে। এদিকে রাত আটটা বাজলেই পুরো শহর বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় রিকশা পর্যন্ত পাওয়া কঠিন।
Advertisement
শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। সন্ধ্যা যেন গভীর রাত। কিছুক্ষণ আগে এসেছে নতুন চালান। মালপত্র গুছিয়ে দোকানে তুলতে কর্মচারীরা সবাই ব্যস্ত। মাসুম একবার দোকানে যায়, একবার গোডাউনে। দূরে নয়, বলাকা সুপার মার্কেটের পেছনেই তার গোডাউন। এর মধ্যে ক্রেতাদের ভিড়। হঠাৎ এক অদ্ভুত লোকের আগমন। গায়ে চটের বস্তা জড়ানো, মাথায় জটপড়া চুল, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ। পাগল-টাগল হবে বোধ হয়। ‘এই, এই, এখানে কী? যাও! এখান থেকে যাও’- ধমক দিয়েই বলে মাসুম। লোকটাও পাল্টা জবাব দেয়, পাগল নয়- স্বাভাবিক মানুষের মতো। ‘আমি তো আপনাকে বিরক্ত করিনি! শুধু দাঁড়িয়েছিলাম। খেতে চাইনি, টাকা চাইনি- তাও আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করলেন।’ মাসুমের মাথায় রক্ত উঠে যায়- ‘তুমি যাবে নাকি মার খাবে? যতসব উটকো ঝামেলা।’
পরদিনও মাসুমের আপসোস হয়নি। ব্যবসায়ী হিসেবে এইটুকু কঠোর তাকে হতেই হতো। কোনো ক্রেতা ভয় পেতে পারতেন। জুতা না কিনে ফিরে যেতে পারতেন। তাতে তার ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল। এমন একজন উটকো লোককে কেন সহানুভূতি দেখাতে হবে!
ঈদ চলে এলো। অনেকটা দেখতে দেখতেই। এই সময়টা আর যার যেমনই কাটুক, মাসুমের দম নেওয়ার সময় থাকে না। কোনদিকে সকাল হয়, কোনদিকে রাত- কে জানে! কিন্তু এত প্রত্যাশার ঈদ আনন্দের হলো না। ঝিরঝির বৃষ্টি পথ আগলে রেখেছে আগের রাত থেকে। ঘরের বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। এমন উৎসবের দিন ঘরে কেটে যাবে! মাসুমের স্কুলের বন্ধুদের অনেকেই এখন ঢাকায় থাকেন। রাজধানীর ব্যস্ততা। চাকরি জীবনে বিশেষ ছুটি নেই। ফলে ঈদের ছুটিতেই আড্ডা জমে। আর কোথাও যাওয়া না যাক, স্টেশন প্ল্যাটফর্মে তো আড্ডা হতেই পারে। বাকি সবাই পৌঁছে গেছে। মাসুমও বের হয় মোটরসাইকেল নিয়ে। কিন্তু বিধি বাম! ফাঁকা রাস্তায় পিছলে গেল বাইক। বেকায়দা অবস্থা। সাহায্য করারও কেউ নেই ধারে-কাছে। পা ভেঙে গেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এক রিকশাওয়ালার দেখা পাওয়া গেল। তিনিই নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। হ্যাঁ, ভেঙে গেছে। প্লাস্টার খোলা হবে একমাস পরে, সে পর্যন্ত বিশ্রাম। একমাস পরে ক্র্যাচ ধরে হাঁটা যাবে। পা নাড়ালে জোড়া লাগতে সময় লাগবে- বলে দিলেন ডাক্তার।
Advertisement
মাসুমের ম্যানেজার খুবই বিশ্বস্ত। রোজ রাতে হিসাব দিয়ে যান, কত বিক্রি হলো। কোন মডেলের জুতা আনা দরকার, কোনটা বেশি চলছে। একরকম তিনি সব সামলাচ্ছিলেন। এর মধ্যে আর কোনো উৎসব ছিল না, তাই খুব বেশি অসুবিধাও হয়নি।
এই দীর্ঘ অবসরের শহরে শয্যাগত একমাস, যাবজ্জীবন সাজার চেয়ে কম না। মাসুম বিবাহিত, স্ত্রীর যত্নের কমতি নেই। রাজপুত্রের মতো দেখতে একটা ছেলেও আছে। বন্ধুরা বাড়ি বয়ে দেখতে আসে। এছাড়া কিছু সময় কাটে টিভি দেখে, গল্পের বই পড়ে। কিন্তু কতক্ষণ? বাজারে কত মানুষ- দেখা হয়, কথা হয়, আড্ডা হয়।
সময় তো আর থেমে থাকে না। ঠিকই কেটে গেল দীর্ঘ একমাস। ডাক্তার প্লাস্টার খুলে দেওয়ার পর হাসপাতাল থেকে সোজা দোকানে গেল মাসুম। ‘ঘরের ভেতরে থাকতে থাকতে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সন্ধ্যার আগে আমি বাসায় ফিরছি না’- সাফ জানিয়ে দিলো সবাইকে।
একমাস পরে মাসুম দোকানে। মার্কেটের সবাই আসছে দেখা করতে। যারা বাড়ি যেতে পারেননি, তারাও জেনেছেন কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটলো। তারপরও, মাসুমের মুখ থেকে না শুনলে চলে? কুশল বিনিময়ের পরের প্রশ্ন- কীভাবে হলো? মাসুমও সগ্রাহে জবাব দিয়ে চলেছে। এভাবেই গড়ালো দুপুর। দুপুরের খাবার এসেছে বাসা থেকে। মাসুম খেতে বসেছে। শীতঋতু চলে গিয়ে এসেছে বসন্তকাল। না ঠিক ঠান্ডা না গরম- আবহাওয়া। মাঝে মাঝে মৃদু বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে। তবে উজ্জ্বল রোদ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ক্যাশ কাউন্টারে বসে খেতে খেতে মুখ তোলে মাসুম- ভর দুপুরে সেই অদ্ভুত লোকটা দাঁড়িয়ে আছে দোকানের সামনে। মাসুমের দিকেই তাকিয়ে আছে।
‘বিচার করাতে জানলে বিচার করানো যায়’- বলেই পাকা সড়ক ধরে হাঁটতে শুরু করে অদ্ভুত লোকটা।
এসইউ/পিআর