পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশ বরাবরই শেয়ারহোল্ডারদের ভালো লভ্যাংশ দেয়। তবে করোনা সংকটের মধ্যে ২০১৯-২০ হিসাব বছরের লভ্যাংশের ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি যে মুনাফা হয়েছে তার থেকে বেশি লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ।
Advertisement
বড় ধরনের লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও দেশীয় বিনিয়োগকারীরা তার খুব একটা সুফল পাবেন না। কারণ কোম্পানিটির মাত্র ১ দশমিক ২১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে দেশীয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। বাকি শেয়ারের মধ্যে ৯০ শতাংশই উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। ফলে কোম্পানিটির লভ্যাংশের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই চলে যাবে দেশের বাইরে।
বহুজাতিক আরেক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার। এ কোম্পানিটিও ২০১৯ সালের লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। রেকর্ড পরিমাণ ১২৫০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে গিয়ে কোম্পানিটি যে মুনাফা দেখিয়েছে তার অর্ধেকই এসেছে শেষ তিন মাসে। অর্থাৎ বছরের শেষ তিন মাসে বছরের প্রথম নয় মাসের সমান মুনাফা হয়েছে।
এ কোম্পানিটিরও স্বল্পসংখ্যক শেয়ার রয়েছে পুঁজিবাজারে। প্রতিষ্ঠানিটির মোট শেয়ারের ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ আছে দেশীয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে আছে ৮২ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং বিদেশিদের কাছে আছে ৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। অর্থাৎ এ কোম্পানিটিও যে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তার সিংহভাগ চলে যাবে দেশের বাইরে।
Advertisement
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বছরের পর বছর ধরে মুনাফার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। এতে বহুজাতিক এসব কোম্পানির বিদেশি উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা লাভবান হলেও দেশীয় বিনিয়োগকারীরা সুফল পাচ্ছেন না। বরং নামমাত্র শেয়ার পুঁজিবাজারে ছেড়ে কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে আরও বড় সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলছেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে ১০ শতাংশ কর ছাড় পাওয়া যায়। তালিকাভুক্ত কোম্পানি মুনাফার ২৫ শতাংশ কর দেয়। তালিকাভুক্ত না হলে ৩৫ শতাংশ কর দিতে হয়। এই সুবিধার ফলে দেখা যায় তালিকাভুক্ত একটি বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের মুনাফার যে ভাগ দেয়, তার থেকে অনেক বেশি কর ছাড় পায়।
এর ব্যাখ্যা দিয়ে ডিএসই’র এক সদস্য বলেন, মেরিকো বাংলাদেশের মাত্র ১ দশমিক ২১ শতাংশ শেয়ার দেশীয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে। এখন এই কোম্পানিটি যদি ১০০ টাকা মুনাফা করে এবং তার সম্পূর্ণ অংশ লভ্যাংশ হিসেবে দেয়, তাহলে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা পাবেন মাত্র ১ টাকা ২১ পয়সা। অথচ কোম্পানিটি কর ছাড় পাবে ১০ টাকা। কারণ তালিকাভুক্ত না হলে তাকে কর দিতে হতো ৩৫ টাকা। ফলে কর-পরবর্তী মুনাফা হতো ৬৫ টাকা। তালিকাভুক্ত হওয়ায় কর দিতে হচ্ছে ২৫ টাকা। ফলে মুনাফা হচ্ছে ৭৫ টাকা। অর্থাৎ দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মুনাফার নামমাত্র ভাগ দিয়ে বড় ছাড় নিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
ডিএসই’র এই সদস্য বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করলেও পুঁজিবাজারে নামমাত্র শেয়ার ছাড়ার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তার খুব একটা সুফল পান না। এখন করোনা পরিস্থিতিতে মেরিকো বাংলাদেশ ২০১৯-২০ হিসাব বছরের ব্যবসায় যে মুনাফা করেছে তার থেকে বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। হঠাৎ কোম্পানিটি এ ধরনের লভ্যাংশ ঘোষণার পেছনের কারণ কী তা ক্ষতিয়ে দেখা উচিত।
Advertisement
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৯৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানিটি। অথচ হিসাব বছরে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৮৪ টাকা ১ পয়সা। অর্থাৎ ৩ কোটি ১৫ লাখ শেয়ারের এই কোম্পানিটি ২৬৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মুনাফার বিপরীতে লভ্যাংশ হিসেবে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২৯৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে মুনাফার থেকে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা বেশি লভ্যাংশ বাবদ দেবে কোম্পানিটি।
এদিকে সম্প্রতি বড় লভ্যাংশ ঘোষণা করা আরেক বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার মুনাফার থেকে কম লভ্যাংশ দিলেও ২০১৯ সালের শেষ তিন মাসের ব্যবসায় মুনাফার বড় ধরনের চিত্র তুলে ধরেছে কোম্পানিটি। লভ্যাংশ ঘোষণা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে কোম্পানিটি উল্লেখ করেছে ২০১৯ সালের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ১৩১ টাকা ৬ পয়সা।
ডিএসই’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকে রেকিট বেনকিজার শেয়ারপ্রতি মুনাফা করে ১৫ টাকা ৪৬ পয়সা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে ২১ টাকা ৮২ পয়সা এবং তৃতীয় প্রান্তিকে ৩০ টাকা ৬৮ পয়সা শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়। এতে তিন প্রান্তিক বা নয় মাসে (২০১৯ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৬৭ টাকা ৯৬ পয়সা। এ হিসাবে ২০১৯ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর এই তিন মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৬৩ টাকা ১০ পয়সা। অর্থাৎ নয় মাসের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটির যে মুনাফা হয়েছিল, মাত্র তিন মাসের ব্যবসায় তার সমান মুনাফা হয়েছে।
২০১৯ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ৬৩ টাকা ১০ পয়সা শেয়ারপ্রতি মুনাফা হলেও, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ২৪ টাকা ৪ পয়সা। অর্থাৎ ২০১৯ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটি যে মুনাফা করে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে তার থেকেও কম মুনাফা করেছে।
এ বিষয়ে একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, রেকিট বেনকিজার এবার ১২৫০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। রেকর্ড পরিমাণ এই লভ্যাংশের পেছনে বছরের শেষ তিন মাসের মুনাফা বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো ২০১৯ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে কী এমন ঘটলো যে কোম্পানিটির মুনাফায় এমন উল্লম্ফন হলো। আবার চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চে তা কমে গেল। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা।
ডিএসই’র পরিচালক শাকিল রিজভী জগো নিউজকে বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বরাবরই বড় লভ্যাংশ দেয়। তবে শেয়ারবাজারে এসব কোম্পানির সীমিতসংখ্যক শেয়ার থাকার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ হয় না। মেরিকো ও রেকিট বেনকিজার আনেক বড় লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। মেরিকো তো মুনাফার থেকে বেশি লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কী কারণে এমন লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা কোম্পানিই ভালো বলতে পারবে।
মুনাফায় উল্লম্ফন ও রেকর্ড পরিমাণ লভ্যাংশ ঘোষণার কারণ জানতে রেকিট বেনকিজারের কোম্পানি সচিব নাজমুল আরিফিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা মোবাইলে কারও সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলি না।
তাহলে কীভাবে আপনাদের বক্তব্য পাওয়া যাবে? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এখন তো আসলে কিছু করার নেই।
এদিকে ডিএসই’র এক সদস্য বলেন, ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়ার (সেবি) নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হতে হলে তাকে ন্যূনতম ২৫ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে হয়। বাংলাদেশের আইনে এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর এরই সুযোগ নিয়ে নামমাত্র শেয়ার ছেড়ে তালিকাভুক্ত হয়েছে। বছরের পর বছর কেটে গেলেও কোম্পানিগুলো নতুন করে শেয়ার অফলোড করছে না। অথচ ঠিকই বড় ধরনের কর ছাড় নিয়ে যাচ্ছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাস্তবে কোনো সুফল পায় না। কারণ অল্প শেয়ার হওয়ার কারণে প্রতিটি কোম্পানিরই শেয়ার দাম আকাশচুম্বী।
এমএএস/এমএফ/এমএস