গুণগত মানসম্পন্ন এবং দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা কারখানায় তৈরি জুতার খ্যাতি ও চাহিদা রয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। ঈদ কিংবা পূজা-পার্বণে জুতার চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তাই উৎসবের সময়গুলোতে পাদুকা শ্রমিকদের দম ফেলারও ফুরসত থাকে না। রাত-দিন কাজ করে পাইকারদের চাহিদা অনুযায়ী জুতা তৈরি করেন তারা। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন।
Advertisement
কদিন পরেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই ঈদে লাভের বিপরীতে লোকসানের পাল্লাই ভারি হচ্ছে পাদুকা শিল্পে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের থাবায় এখন পর্যন্ত এই শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ ৮ কোটি টাকারও বেশি। চলমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সম্ভাবনাময় এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখাই দায় হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, মাহমুদ আলী নামে ভারতের পাটনা শহর থেকে আসা এক ব্যবসায়ী ১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কুমারশীল মোড়ে একটি পাদুকা কারখানা স্থাপন করেন। বর্তমানে জেলা শহরের পীরবাড়ি, নাটাই, ভাটপাড়া ও রাজঘরসহ কয়েকটি এলাকায় প্রায় দেড়শ কারখানা সচল রয়েছে। এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক হাজার শ্রমিকের। বাজারে বিদেশি জুতার সঙ্গে পাল্লা দিতে হাতের পাশাপাশি এখন মেশিনেও জুতা তৈরি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা কারখানাগুলোতে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জুতা নিয়ে যান। প্রতি জোড়া জুতা পাইকারাদের কাছে বিক্রি হয় ১৮০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
পাদুকা শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত রোজার মাসকেই পাদুকা শিল্পের মৌসুম ধরা হয়। এই মৌসুমে ব্যবসায়ীরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি শ্রমিকরাও বাড়তি টাকা আয় করেন। শুধুমাত্র রোজার মাসেই একেকটি কারখানায় কোটি টাকারও বেশি জুতা বিক্রি হয়। আর তাই ঈদুল ফিতর কেন্দ্রিক বাজার ধরার জন্য এক মাস থেকেই প্রস্তুতি নেন পাদুকা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। রোজা শুরুর ১০-১৫ দিন আগে থেকে রাত-দিন মিলিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে এবারের মৌসুমে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন পাদুকা ব্যবসায়ীরা। গত ২৫ মার্চ থেকে জেলার সবকটি পাদুকা কারখানা বন্ধ রয়েছে। এতে করে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার জুতা বিক্রি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘ সময় ধরে কারখানা বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন পাদুকা শ্রমিকরা। এতে করে মানবেতর দিন কাটছে প্রায় তিন হাজার পাদুকা শ্রমিকের।
Advertisement
অবশ্য ঈদুল ফিতরের কেনাকাটা করার সুবিধার্থে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ১০ মে থেকে সীমিত পরিসরে বিপণি বিতানগুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার। তবে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কোনো বিপণি বিতান খোলেনি।
এছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে কারখানা বন্ধ থাকায় যে পরিমাণ লোকসান হয়েছে তা শুধুমাত্র ১০/১৫ দিন ব্যবসা করে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব না। বিপণি বিতান খুললে মানুষজন আসবেন কি-না সেটি নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন পাদুকা ব্যবসায়ীরা।
শহরের পীরবাড়ি এলাকার অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের সেলাইম্যান মো. সেলিম জানান, পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের সব দায়িত্ব তার। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে কারখানা বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে এখন কষ্ট হচ্ছে। কারও কাছ থেকে চেয়ে ত্রাণ সহায়তাও নিতে পারছেন না। অন্য কোনো কাজ না জানায় চরম কষ্টে দিন কাটছে তার পরিবারের।
একই কারখানার আপারম্যান নাহিদুল ইসলাম বলেন, পাদুকা শিল্পের এমন দুর্দিন আগে কখনও দেখিনি। কাজ না থাকায় চরম অর্থকষ্টে দিন কাটছে আমাদের শ্রমিকদের। পেট তো আর ভাইরাস চিনে না। এভাবে আমরা কতদিন চলব? এই ভাইরাস আমাদের পথে বসিয়ে ছাড়বে।
Advertisement
অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের স্বত্বাধিকারী মো. রাকিবুর রহমান বলেন, ব্যবসা বন্ধ থাকায় শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছি না। কারখানায় উৎপাদন না থাকলেও লোকসান ঠিকই গুণতে হচ্ছে আমাদের। যে কাঁচামাল মজুত রেখেছিলাম সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। আমাদের সারা বছরের ব্যবসা হয় রোজার মাসে। এই রোজায় আমার কারখানা থেকে প্রতিদিন আট লাখ টাকার জুতা বাজারজাত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু ভেস্তে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পথে বসতে হবে।
দিশা সুজের স্বত্বাধিকারী মো. নাদিম বলেন, কারখানা বন্ধ হওয়ার আগের দিন ধার-দেনা করে শ্রমিকদের বেতন দিয়েছি। এখন কারখানা বন্ধের কারণে শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে পারছি না। সারা বছর মার্কেটে যে বাকি দিয়েছি বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই টাকাগুলোও ওঠানো সম্ভব না। রোজা উপলক্ষে আমার ফ্যাক্টরি থেকে অন্তত দুই লাখ টাকার জুতা বাজারজাত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু কারোনাভাইরাসের কারণে সেটি করতে পারছি না।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহসিন মিয়া বলেন, সারা বছরের লোকসান আমরা এই মাসে ব্যবসা করে পুষিয়ে নিতে পারতাম। কারণ এই রোজার মাসে একেকটি কারখানা থেকে কয়েক কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করা হতো। অথচ এবার এই রোজার মাসেই আমাদের সবচেয়ে বেশি লোকসান হচ্ছে। এখন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কারখানা খুলে দেয়ার পাশাপাশি সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
আরএআর/এমকেএইচ