মতামত

করোনার পরে!

করোনা-ঝড়ে সারাবিশ্ব আজ উত্তাল। এই ঝড় কবে থামবে, বা আদৌ থামবে কি না আমরা জানি না। ১৯১৮ সালের সেই স্প্যানিশ ফ্লু’র আগ্রাসনের (৫ কোটির বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল সেই ফ্লু’র আক্রমণে) পর এমন বিশ্ব আর কখনও দেখেনি কেউ। ‘প্যান্ডেমিক পানিশমেন্ট’ বলতে যা বুঝায়, ঠিক তাই চলছে এখন। প্রকৃতির প্রতিশোধ। মমতাহীন ক্ষমতার উদগ্র অহংকারে আমরা ধরাকে সরাজ্ঞান করেছিলাম একদিন। কারও কাছে আছে জনবিধ্বংসী নিউক্লিয়ার উয়েপন, কারও আছে নিগূঢ় রাজনৈতিক কূটচাল, আবার কেউ ভাবে অর্থনৈতিক দাপটে পুরো বিশ্বকে সে কিনে নিতে পারে। অথচ এখন সেসব শুধু ব্যর্থই নয়, নিছক অর্থহীন ভাবনা বলে মনে হয়। করোনার করালগ্রাস কেড়ে নিচ্ছে সব।

Advertisement

করোনার পরে কী হবে! আমরা কেউ সে বিষয়ে কিছু আন্দাজ করতে পারি কি! বিশ্বের কথা বাদ, আমি ভাবছি আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের কথা। রকমারি আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন তো আসবেই, কিন্তু আমি ভাবছি মানুষ তার ব্যক্তিচরিত্র হারাবে না তো! হয়তো নিজে সুরক্ষিত থাকতেই মানুষ এটা করবে। ‘সোশাল ডিসট্যান্সিং’ বলে আমরা যা করছি বা করতে বাধ্য হচ্ছি, তাতেই মনুষ্যত্ব এখন অনেকটাই লুপ্ত। করোনা সংক্রমণের ভয়ে বাবা-মাকে বাইরে ছুড়ে দিচ্ছে সন্তান, পাড়া-প্রতিবেশী তার লাশ অবধি দাফন করতে দিচ্ছে না! স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, এমনকি, মানুষ এখন মানুষকেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।

মানুষ নাকি সমাজবদ্ধ জীব! অথচ এখন চলছে ‘বিসামাজিকীকরণের’ জামানা। সতি বলতে, এটা না করেও এখন উপায় নেই, কেই বা মিছেমিছি অন্যকে জড়িয়ে ধরে নিজে সংক্রমিত হতে চায়! অর্থাৎ অন্য প্রাণী বা বন্যপ্রাণী নয়, মানুষ এখন মানুষকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে। মানুষ তার মানবতা, মনুষ্যত্ব ও সঙ্গপ্রিয়তা হারাচ্ছে- শুধু করোনার নির্মম ছোবল থেকে বাঁচবে বলে।

করোনাভাইরাস যদিওবা থামে, আমাদের কী হবে! কোটি কোটি লোক বেকার, প্রকৃত অর্থেই তাদের কোনো কাজ নেই। তারা দিন আনে দিন খায়, কাজ না থাকলে তারা খাবে কী! সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা বস্তুত অপ্রতুল। তার সুষম বণ্টনেও ঘাটতি রয়েছে- যে পায়, শুধু সে-ই পায়, অন্যরা দিনের পর দিন উপোস থাকে। খালি পেটে ধর্ম হয় না আমরা জানি। ফলে এসব ভুখা-নাঙ্গা মানুষের কাছ থেকে মানবিক আচরণ প্রত্যাশা করা বৃথা। একসময় খিদের জ্বালা সইতে না পেরে তারা রাস্তায় নামবে, বিত্তশীলদের মেরে ধরে তারপর খাবার কেড়ে খাবে।

Advertisement

দেশের বেশিরভাগ কল-কারখানা এখন বন্ধ। তারা ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে অপারগ। কেউ কেউ আবার এই অবস্থার সুযোগও নেবে। চুপিচুপি কারখানা চালু রাখছে, কিন্তু সরকারের কাছ থেকে মোটা অংকের প্রণোদনা সুবিধা নিয়েও তারা শ্রমিকদের বেতন দেবে না, ওরা আরও বেশি করে ফুলে-ফেঁপে উঠবে বটে, তবে শান্তি পাবে না। ওই যে, করোনার ভয়! কখন জীবন যায়! বড্ড অনিশ্চয়তা।

করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে, ফলে অনাগত দিনে রেমিটেন্সের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। প্রচুর শ্রমিক বেকার হয়ে ফেরত আসবে দেশে। ইতোমধ্যেই তারা আসতে শুরু করে দিয়েছে। লাখ লাখ বেকার শ্রমিক দেশে ফিরলে শুধু যে রেমিটেন্স ঘাটতি দেখা দেবে তাই নয়, তারা দেশে এসে বরং নতুন করে বেকারত্বের সমস্যা সৃষ্টি করবে। তাদের সেই গলার রগ ফুলিয়ে বলা ‘রেমিটেন্সের বুলি’ আর শোনা যাবে না। এও কি তবে প্রকৃতির প্রতিশোধ!

ইতোমধ্যে কথা উঠেছে, কোনটা বেশি জরুরি- জীবন নাকি জীবিকা। আমার মতে দুটোই। করোনাভাইরাসের ছোবল সইতে না পারলে জীবন যাবে ঠিক, ফলে অর্থ-বিত্ত বা জীবিকা অর্থহীন হয়ে পড়বে। আবার করোনার কামড়ে না মরলেও দুঃখ-দুর্দশা ও হতাশা যখন নিত্যসাথী, তখন আর তাকে জীবন বলা যায় না, জীবন্মৃত হয়ে বাঁচতে হবে আমাদের। এই জীবন আমাদের কারও কাম্য নয়।

পারিবারিক জীবনের কথা বলি। অনেকেই আছেন যারা কিনা একবেলা ফাস্টফুড না খেলে ঘুমাতে পারে না, তাদের অবস্থা এখন দোজখের শামিল। এদের টাকা আছে তাই আপাতত দৈন্যের কিছু নেই। কিন্তু তাদের কষ্ট এই- টাকা দিয়ে কিছু কিনে খেতে পারছে না, কারণ দোকানপাট সব বন্ধ। আবার ওদিকে করোনার ভয়ও কিছু আছে। না জানি, কী খেয়ে আবার আলটপকা পটল তুলি! বস্তুত, যাদের অনেক আছে, তাদেরই হারানোর ভয় সবচেয়ে বেশি। ধনীর ধনের বড় লোভ, পেটুকরাই খাবারের চিন্তা বেশি করে।

Advertisement

ব্যাংকে অনেক অলস টাকা জমে আছে। কোটি কোটি টাকা। কিন্তু এখন সেসব শুধুই একটি সংখ্যা মাত্র। সবখানে কেমন একটা অমানবিক হতাশা কাজ করে। টাকা দিয়ে কী হবে, যদি মনের মতো ঈদশপিং করতে সিঙ্গাপুর যেতে না পারি! সামান্য কাশি হয়েছে, ক্ষয়কাশ নয়, তবু তাদের বাইরে কোথাও চিকিৎসা করাতে যেতে হবে। বছরে অন্তত চারবার পরিবার-পরিজন নিয়ে বিদেশভ্রমণ করতেন, সেই সুযোগও এখন হাতছাড়া। তাহলে এত এত টাকা দিয়ে কী হবে এখন! এই নিয়ে ধনীরা ধুঁকছেন। তাদের মনেও শান্তি নেই। তাদের ভোগবাদী চিন্তা ঠোক্কর খেয়েছে খুব। সত্যি, নির্মোহ করোনাভাইরাস সব্বাইকে একেবারে ধুয়ে দিয়েছে। বড্ড ‘সমাজতান্ত্রিক’ জীবণু এটি। আইনের চোখে সকলে সমান (অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হয়) না হলেও করোনার চোখে তাই। কাউকে সে রেয়াত করে না।

এবার একটু সরস কথা (চরস) বলি। করোনার কারণে স্বামী-স্ত্রী খুব কাছে এসেছে, দূরে সরে গেছে প্রেমিক-প্রেমিকা। কারণ আজকালকার দিনে প্রেম মানেই বড্ড কাছাকাছি আসা, কাছে থাকো দূরে যেও না। অর্থাৎ উল্টো করে বললে, ‘আউট অব সাইট- আউট অব মাইন্ড’ টেকনিক চলছে। করোনার ফলে তাদের আর দেখা হয় না, ওদিকে লকডাউন স্বামী-স্ত্রীকে একেবারে একাকার করে দিয়েছে। অযথা, অপ্রয়োজনে। ফলে হয়েছে কী, তারা একে অপরকে এখন আর সহ্য করতে পারছে না। ওই যে, অর্থনীতি বলে, পণ্যের সরবরাহ বেড়ে গেলে তার দাম এবং চাহিদা দুটোই কমে যায়। তাদের মাঝে নিত্য খিটিমিটি লাগে- কে রান্না করবে, কে মশারি টাঙাবে তাই নিয়ে নিত্য শালিস-মীমাংসা বসে, তাতে মজা পায় পরিবারের ফিচেল ছেলেছোকরারা। ফিক ফিক করে হাসে। বস্তুত, এমন বাপ-মা তারা আগে আর কখনও দেখেনি।

করোনার ফলে রুবি-রবিনের প্রেম সহসাই কেচে যায়। কারণ তারা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানছে। ওদিকে একই ভবনে থাকার কারণে রুবির সাথে ফায়েজের, আর রবিনের সাথে লাভলির দুর্দান্ত প্রেম হয়। অর্থাৎ এখানেও পরিবর্তনের ঝড় ওঠে। সুবিধাবাদী প্রেম- এখন করোনার তালে পা ফেলে নাচছে! রুবি ও রবিন জানে, যাকে কাছেই পাব না তাকে নিয়ে মিছে স্বপ্ন দেখে লাভ নেই। তাতে স্বপ্নদোষ হয়। তারচেয়ে বরং কাছেপিঠে যা পাও তাই লুটেপুটে খাও। একটাই জীবন, কখন করোনা এসে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে কে জানে! বড্ড অনিশ্চয়তার মাঝে আছি আমরা। সত্যি, জীবন এখন খুব ছোট আমাদের। করোনা এসে জীবনের ডানা ছেঁটে দিয়ে গেছে। আমরা এখন আকাশ-পাতাল স্বপ্ন দেখতেও ভুলে গেছি। বড্ড নিরস আর রোবটিক এই জীবন।

পড়ালেখা? চুলোয় যাক। পোলাপান প্রথম দিকে বেশ খুশিই ছিল। পড়ালেখা নেই, শুধু সিনেমা দেখো, খাও আর ভিডিও গেম খেলো। কিন্তু পিৎজা-পাস্তা নেই, দালগোনা কফি নেই, জ্বলা-পোড়া চিকেন কিংবা মাটন নেই, অফুরান আড্ডা নেই, ওরাও দিনকে দিন কেমন যেন ম্যাদা মেরে গেছে। নাহ, এমন জীবন ওরা চায় না। ফাঁকতালে ব্যবসা করছে কিছু মোবাইল কোম্পানি! তারা সমানে ইন্টারনেটের জিবি বেচছে, অথচ নেট দুর্বল। লোক ঠকিয়ে দেদার টাকা কামায় তারা। যত্তসব বেনিয়ার জাত! সবখানে জুয়াচুরি। এরা মরবে তাও লাভের গুড় ছাড়বে না।

কিছু অর্বাচীন এখনও বুঝে উঠতে পারেনি করোনার অভিঘাত কত নিষ্ঠুর। ওরা এখনও টাকা কামানোর ফিকির খুঁজছে। চাল চুরি থেকে শুরু করে সরকারি তেলের গুদাম সাফ, মাস্ক নিয়ে জালিয়াতি, ভুয়া পিপিই বিক্রি- কী না করছে ওরা। অথচ সে জানে না, তার ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে নির্মম করোনাভাইরাস। যখন মরার সময় হবে, তখন একটু শ্বাস নিতেও তার জান বেরিয়ে যাবে। নানান রকম টোটকা বেটে খাওয়ালেও সে আর বাঁচতে পারবে না। তার পদ-পদবি, ক্ষমতা কিংবা কাড়ি কাড়ি টাকা কোনো কাজেই আসবে না। নেহাত ভাগ্য ভালো হলে হয়তো চার হাত মাটি পাবে, নইলে শেয়াল-শকুনে ছিঁড়ে খাবে।

বুঝতে পারছি, অনাগত দিন- আরও কঠিন। আমরা লকডাউন মানি না, বুঝি না, বুঝতেও চাই না। আমরা দর্জিগিরি বুঝি, ওয়ার্ক-অর্ডার চিনি, আমরা জলের দরে মনুষ্যত্ব কিনি। ধর্মান্ধ যারা তারা অলৌকিক কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে, কেউ কেউ এই নিয়ে নুড়িপাথর আর জড়িবুটির ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, দেশে দেশে ল্যাবরেটরিতে করোনা-ভ্যাকসিন বানানোর চেষ্টা চলছে, ওষুধের ফরমুলা নিয়ে মুলামুলি চলছে, চলছে কূটচাল, অথচ কিন্তু কেউ জানে না কবে এর থেকে মুক্তি মিলবে। আদৌ মিলবে তো!

অদ্ভূত এক অসুখ করেছে পৃথিবীর। উঁচু-নিচু, ছোটবড়, ধনী-নির্ধন সবার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে এই করোনা। হয়তো উদাসী ডেভেলপাররা একবার মঙ্গলগ্রহের জমি বেচবে বলে সাইনবোর্ড লাগাবে। শৌখিন পাত্তিওয়ালারা সেখানে দীর্ঘ লাইন দেবে। কিন্তু কেউ আর এখন গলার রগ ফুলিয়ে বলতে পারবে না, আমার সেকেন্ড হোম আছে আমি সুরক্ষিত, আমি পাশ্চাত্যে আছি তাই ভালো আছে, আমি মাল্টিবিলিওনিয়ার, তাই আমাকে আনত প্রণাম জানাও।

উঁহু, মোটেও তা নয়। করোনার কাছে তুমি উঁকুনের মতো অসহায় এবং নিকৃষ্ট। জাস্ট উঁকুন!

এইচআর/বিএ/পিআর