করোনার এপিসেন্টার (কেন্দ্রস্থল) নারায়ণগঞ্জে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের দুর্দশা দেখে নারায়ণগঞ্জবাসীকে চিকিৎসা সেবা দিতে সিরাজগঞ্জ থেকে স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে চলে এসেছেন ডা. মশিউর রহমান। ৩৯তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ছিলেন।
Advertisement
সহকারী সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে চলে এসেছেন নারায়ণগঞ্জে। তার উদ্দেশ্য করোনাভাইরাসের এ মহামারিতে মানুষকে চিকিৎসা দেয়া। তবে করোনাভাইরাসে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত জেনেও নিজের ইচ্ছায় নারায়ণগঞ্জ বদলির আবেদন করায় নারায়ণগঞ্জবাসীর মধ্যে ডা. মশিউরকে নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়।
ডা. মশিউর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৭ এপ্রিল মেডিকেল অফিসার হিসেবে নারায়ণগঞ্জ ৩শ শয্যা হাসপাতালে বদলি করা হয় তাকে। গত ৩০ এপ্রিল থেকে নারায়ণগঞ্জ ৩শ শয্যা হাসপাতালের ফ্লু কর্নারে করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন।
এছাড়া হাসপাতালটির আইসোলেশনে ভর্তি কোভিড পজিটিভ রোগীদেরও চিকিৎসা দিচ্ছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জে যোগদানের পর তিনি বলেন, মানুষের সেবা করতেই এ পেশা বেছে নিয়েছি। মানুষের সেবা করে যেতে চাই। মরণকে ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে। আলোচনা শুরু হয় ডা. মশিউর রহমানের নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
Advertisement
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন নটর ডেম কলেজে। এরপর খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে ৩৯তম বিসিএস ক্যাডার হন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
মশিউর রহমান বলেন, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় কর্মরত ছিলাম। কিন্তু সেখানে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো করোনা রোগী ছিল না। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আমাদের চিকিৎসকরা করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু চিকিৎসক তো সব জায়গায় সীমিত। আমি দেখলাম সিরাজগঞ্জে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। তাই মনে মনে ইচ্ছা জন্মালো আমি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সেবা করতে পারতাম। জাতির এ সময় যদি পাশে দাঁড়াতে পারি তাহলে আমার মেধা ও পরিশ্রম কাজে লাগবে। কিন্তু হঠাৎ করে উপায় মিলছিল না। তাই উপায় খুঁজতে লাগলাম। যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বদলি হতে চাই, তাহলে ফাইল চালাচালি ও অর্ডার হতে সময় লাগবে। তাই আমি নিজেই ২৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরে মহাপরিচালক বরাবর নারায়ণগঞ্জে বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করলাম। এরমধ্যে আমি আমার মায়ের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করছি। মা তখন আমাকে বলল, সব উপজেলা ও জেলাই তো আক্রান্ত হতে পারে। তুমি যদি নারায়ণগঞ্জ যেতে চাও সিদ্ধান্ত তোমার। আমি মাকে বুঝালাম যথাযথ প্রটেকশন পেলে ভাইরাস আক্রান্ত হবো না। আমার পরিবার আমার সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। তারা সায় দিলেন। তবে তাদের দুশ্চিন্তা কমে না।
ডা. মশিউর রহমান বলেন, দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই আমি বিষয়টা মনিটর করছিলাম। কোনো রোগী যেন অবহেলার শিকার না হয়, স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত না হয়। আমাদের তাড়াশে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি। করোনার উপর অনলাইনে ট্রেনিং করেছি। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী পেলে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে ইচ্ছুক ছিলাম আমি।
তিনি আরও বলেন, আমার নানা বীর উত্তম হাবিবুর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগামী সৈনিক। বীর উত্তম সুবেদার হাবিবুর রহমান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বিজিপি পিলখানার সদর দফতরের ঢাকা নিউ মার্কেট সংলগ্ন ৩ নম্বর গেটের নাম বীর উত্তম হাবিবুর রহমান। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি নিজের জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৬ বছর তিনি পঙ্গু থাকার পর ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নানার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমিও করোনা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই। আর নানার অনুপ্রেরণাতেই এ করোনাযুদ্ধের একজন সৈনিক হতে চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন জানিয়েছিলাম। আমার চিন্তা ছিল আমি যদি সাহস করে যাই তাহলে আমার দেখাদেখি আরও কয়েকজন এগিয়ে আসতে পারে। এই কোভিড যুদ্ধে চিকিৎসকদেরই অগ্রগামী হতে হবে। আর আমার নানার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা শুনছি। এসব শুনে দেশসেবায় ছোটবেলা থেকে উজ্জীবিত হয়েছি। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া আমরা না এগিয়ে আসলে মানুষ কোথায় সেবা পাবে। এটা আমাদের দায়িত্ব। আর দায়িত্ব থেকে কারও পালানোর উপায় নেই।
Advertisement
শাহাদাত হোসেন/এমএএস/এমকেএইচ