জাগো জবস

জীবনের প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার হন মোস্তফা

ডা. মোস্তফা কামাল বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার (ওপিডি)। বাবা মো. দলিল উদ্দিন, মা মাহফুজা বেগম। তিনি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন।

Advertisement

সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—

ছোটবেলা কেমন কেটেছে?ডা. মোস্তফা কামাল: নিভৃত গ্রামে সবার জীবন যেমন কাটে; তেমনই কেটেছে ছেলেবেলা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মক্তবে যাওয়ার সাথে সাথে বাগানে আম কুড়ানো। শীতের সকালে খেজুর গাছের রসভর্তি হাড়ি নামানো। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ছোটবেলায় যা যা করার, সবই করেছি। সেই দুরন্তপনায় পড়াশোনাটাও করেছিলাম ঠিকঠাক। না করে উপায় কি! বাবা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তার হাতেই পড়াশোনার হাতেখড়ি। তিনি স্কুলে যাওয়ার সময় আমাদের সঙ্গে করেই নিয়ে যেতেন। আর ভয় পেতাম বেশি মাকে। তিনিই শাসন করতেন বেশি। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ ছিলাম। বিধায় বড় দুই বোনের আদর-স্নেহে মায়ের শাসন বেশি গায়ে মাখতে হয়নি। আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই ছিলেন আমার পরম বন্ধু। যেখানেই দুরন্তপনা করতাম, ভাই সাথেই থাকতেন।

পড়াশেনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?ডা. মোস্তফা কামাল: যখন আমি সমিতির হাট এ কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি সম্পন্ন করে অষ্টম শ্রেনিতে উত্তীর্ণ হই; তখনই আমার জীবনে আসে বিরাট পরিবর্তন। আমাকে ছাড়তে হয় ওই স্কুল। আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের দুটি স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য গেলাম। কিন্তু কোনটাতেই মন বসাতে পারিনি। ফলে পড়াশোনায় ছেদ পড়ল কয়েক মাস। বাবা একদিন ডেকে আমার কাছে জানতে চাইলেন, কোথায় পড়াশোনা করতে চাই। আমি সেদিন সাহস করে বলেছিলাম, শহরে যাবো। তখন আমাদের কালকিনি উপজেলাই আমার কাছে বড় শহর। অনেক কষ্ট করে ভর্তি হলাম কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। শুরু হলো নতুন জীবন, নতুন করে পড়াশোনা। স্কুল জীবনে কখনো দ্বিতীয় হইনি। কিন্তু স্কুল পরিবর্তনের কারণে নবম শ্রেণিতে রোল পেছালো, হলাম চতুর্থ। তবে স্কলারশিপটা পেয়েছিলাম বলে স্কুলে কখনো ফি দিতে হয়নি। দশম শ্রেণিতে আমার সেই আগের অবস্থানে ফিরে এলাম, রোল এক। এরপর ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে এক বছর পরে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। সেখান থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করলাম।

Advertisement

বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?ডা. মোস্তফা কামাল: আমি যখন কলেজে পড়ি; তখন আমার চাচাতো ভাই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার কাছ থেকেই বিসিএস সম্পর্কে প্রথম জানি। মেডিকেলে পড়াশোনা করা অবস্থায় অনেক বড় ভাইকে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকতে দেখি। তখন মনে মনে ইচ্ছা জাগে ক্যাডার সার্ভিসে চাকরি করার।

বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—ডা. মোস্তফা কামাল: আমি তখন এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সামনে চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষা। মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার ভালো প্রস্তুতি থাকলেই যে পেশাগত পরীক্ষায় একবারে পাস করা যাবে, বিষয়টি এমন ছিল না। ফলে মারাত্মক দুশ্চিন্তায় ছিলাম পরীক্ষা নিয়ে। পরীক্ষার কয়েক মাস আগে ৩২তম বিশেষ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি এলো। তাতে দেখলাম, এক চান্সে এমবিবিএস ফাইনাল প্রফেশনাল পাস করার শর্তে আমি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবো। কাছের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে আমরা কয়েকজন আবেদন করলাম।

এরপর কয়েক মাস কেটে গেল। আমি ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাস করলাম। শুরু হলো ইন্টার্নশীপ। একইসাথে শুরু হলো আমার বিয়ের প্রস্তুতি। এরমধ্যেই প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সময়সূচি দিয়ে দিলো পিএসসি। কিন্তু বিয়ের তারিখ ঠিকঠাক। বিয়ের আঠারো দিন পরই পরীক্ষা। প্রস্তুতির জন্য দিশেহারা হয়ে ভর্তি হলাম একটি কোচিং সেন্টারে। মাঝেমধ্যে সেখানে যাই, হাসপাতালে ডিউটি করি, আর রাত জেগে পড়াশোনা। বিয়েও হলো। কিন্তু থাকতে হলো হোস্টেলে। যা শ্বশুরের বাসা থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বে। সে এক দুর্বিষহ জীবন ছিল।

প্রিলিমিনারি ও রিটেন যখন পাস করলাম; তখন ৩৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি এলো। সেখানেও আবেদন করলাম। যখন ৩২তমের ভাইভার রেজাল্ট পেলাম; ততদিনে ৩৩তম প্রিলিমিনারি ও রিটেন পাস করেছি। আগেরটায় সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ায় ৩৩তমের ভাইভা আর নেয়নি পিএসসি। এভাবেই ‘বন্ধুর পথ’ অতিক্রম করতে হয়েছে এ ক্যাডার সার্ভিসে আসতে।

Advertisement

কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?ডা. মোস্তফা কামাল: আমার ইন্টার্নশীপ শেষে ৮ মাস পরে আমি সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। এ আট মাসে আমি সরকারি বেতনের কয়েকগুণ বেশি বেতনে চাকরি করেছি এনজিওতে। কিন্তু আমার বাবা চাইতেন, আমি সরকারি চাকরি করি এবং দেশের আপামর জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখি। তার প্রেরণাই আমাকে বেশি উৎসাহ দিয়েছে। আমার মা, ভাই, বোন, সর্বোপরি আমার স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন।

একজন চিকিৎসক হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?ডা. মোস্তফা কামাল: আমি এবার নাক-কান-গলা বিষয়ের উপর স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি। আল্লাহর অশেষ কৃপায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে পারলে শারীরিক প্রতিবন্ধি, মূক ও বধিরদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে।

সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী? ডা. মোস্তফা কামাল: আমি এখনো আমাদের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহিঃ বিভাগে কর্মরত আছি। এখানে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমি আমার ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছি। যাতে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে বা অন্য কোন রোগে অসুস্থ হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা আমার কাছ থেকে নিতে পারে। আমি ফেসবুক পেজ খুলেছি দেশের মানুষকে সচেতন করার জন্য। এমনকি করোনা সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা সবার মাঝে পৌঁছে দিতে। যেন কেউ ভুল তথ্য নিয়ে কুসংস্কারের পেছনে না ছোটে। লকডাউনের কারণে আমার পরিচিত, আত্মীয় যারা আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন, আমার সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি এবং এখনো করছি। সরকারের জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবার যেকোন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে সব সময় প্রস্তুত আছি।

এসইউ/জেআইএম