ড. মনসুর আলম খান
Advertisement
কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য প্রথম রোগী ‘প্যাসেন্ট জিরো’ শনাক্তের পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়েছে। ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে প্রথম রোগী শনাক্তের পর থেকে বিশ্বব্যাপী এখন আক্রান্তের সংখ্যা ৩৬ লাখের বেশি। মৃত্যুর সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে আরেকটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার। আশঙ্কার তালিকায় আছে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাজনিত মৃত্যুও। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মতে, “Covid-19 pandemic could now be fusing into a hunger pandemic”. আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) এক প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝড় হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, “The COVID-19 pandemic has all the makings of a perfect storm for global malnutrition”.
নজিরবিহীন লকডাউনের প্রভাবে খাদ্য ও কৃষি পণ্য সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আছে রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের আশঙ্কাও। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো তোরেরো বলেছেন, “The worst that can happen is that governments restrict the flow of food”। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উভয়েই দেশগুলোতে খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এরকম রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরুদ্ধে গত ২৯ এপ্রিল সতর্ক করেছে। সেদিনই অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল রাশিয়া গম, ভুট্টা, বার্লি ও আন্যান্য কৃষিজ পণ্য রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এখানে উল্লেখ্য করা যেতে পারে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাশিয়া ৩৫০ লাখ টনের বেশি গম রফতানি করেছে এবং বাংলাদেশ ৫২ লাখ টন গম আমদানি করেছে। বিশ্ব বাজারের এই চাহিদা-যোগান প্রক্রিয়া করোনার প্রভাবে নিশ্চিতভাবে হুমকিতে আছে। এমন সময়ে আমাদের জানতে ইচ্ছে করে, আগামী দিনগুলোতে আমরা কী খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারব? না করোনা আমাদের ভাতেও মারবে?
না, করোনা আমাদের আপাতত ভাতে মারতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশে চালের (Clean Rice) মজুদ সে কথাই বলে। হিসাবটা দেখে নেয়া যাক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আউশ এবং আমন উৎপাদিত হয়েছে যাথাক্রমে ৩০ এবং ১৫৫ লাখ টন। চলতি বোরো উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ২০৪ দশমিক ৩ লাখ টন। সব মিলিয়ে ৩৮৯ দশমিক ৩ লাখ টন। আমাদের যে স্থায়ী অতিথি, সেই ১০-১১ লাখ রোহিঙ্গাসহ এই এক বছরে ভাতের জন্য দেশে (Human Consumption) দরকার প্রায় ২৫০ লাখ টন চালের। বাকি থাকে ১৩৯ দশমিক ৩ লাখ টন চাল। উৎপাদনের ২৬ শতাংশ হিসেবে গোখাদ্য, পোল্ট্রি, শিল্প কারখানা, অপচয় ইত্যাদি (Non- Human Consumption) খাতে ব্যবহৃত হবে আরও ১০১ দশমিক ২ লাখ টন। বাকি ৩৮ দশমিক ১ লাখ টন চাল থাকবে উদ্বৃত্ত। হিসাবটা কাটায় কাটায় না হলেও গত কয়েক বছর যাবতই গড়ে ৩৫ লাখ টন করে চাল উদ্বৃত্ত থাকছে। এই মুহূর্তে দেশে ৬০-৭০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত আছে। যার সাথে বোরো থেকে যোগ হতে যাচ্ছে আরও প্রায় ৩৮ লাখ টন। দেশের বর্তমান মজুতকৃত চাল দিয়ে আগামী ৭-৮ মাস নিশ্চিত থাকা যাবে। সামনে আসছে আউশ, তারপর আবার আমন। এসব কারণে করোনা আসার আগে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে কিছু চাল বিদেশে রফতানির পথ খোঁজা হচ্ছিল।
Advertisement
আর এখন করোনাকালে চাল রফতানির কথা মুখে নেয়া বাহুল্য। এখন দরকার বোরো ধান ঘরে তোলা। বিশেষ করে হাওরের বোরো ধান। এ বছর আমাদের বোরো আবাদ হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে। তার মধ্যে হাওর এলাকায় (সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া এই সাত জেলার নিম্নাঞ্চল) হয়েছে ৪ দশমিক ৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে। ১৯৯৬-৯৭ সাল পর্যন্ত এসকল জমিতে ধানের আবাদ হতো কম। মূলত ১৯৯৮ সাল থেকে হাওরে ব্যাপক ভিত্তিক বোরো আবাদ করা হয়। আর এখন দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন হাওরের উপযোগী উন্নত জাত। ১৪০-১৪৫ দিনে পরিপক্ব হয়। ফলনও আগের চেয়ে ঢের বেশি। দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১০ ভাগ আসে এসব হাওর থেকে। হাওর অধিবাসীদের একমাত্র ফসল এটি। তাই হাওর থাকে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। এ অঞ্চলের ধান ঠিক মত ঘরে ওঠানো গেলো কি-না, এই নিয়ে থাকে সকলের উৎকণ্ঠা। কৃষক, কৃষি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন, পাইকার, নীতিনির্ধারক সকলেই তাকিয়ে থাকেন হাওরের দিকে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কয়েকদিন এদিক-সেদিক হলে তেমন ক্ষতি নেই। কিন্তু হাওরে ভিন্ন। এবারের উৎকণ্ঠা ছিল আরও বেশি। করোনার কারণে।
এবার হাওরে যখন ধান পাকে-পাকে তখনই করোনার আগমন। এমনিতেই ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিকের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। এবার লকডাউনের কারণে শ্রমিক পাওয়া নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়। কী হয়, কী হয় অবস্থা। শেষে সবার সহযোগিতায় সারা দেশ থেকে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ থেকে শ্রমিক নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু মূল কাজটি সম্পন্ন করা হয় যন্ত্র দিয়ে। আশেপাশের জেলায় যত হারভেস্টার ছিল, ছিল যত রিপার, সব পাঠিয়ে দেয়া হয় হাওরে। আর এভাবে বাংলাদেশ আপাত শঙ্কামুক্ত হয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণের হাত ধরে।
করোনাকে ফাঁকি দিয়ে সুনামগঞ্জের শনির হাওরে ব্যস্ত সময় পার করছে জাপানিজ ইয়ানমার কোম্পানির স্মার্ট কম্বাইন হারভেস্টার। কৃষক নূরুজ্জামানের ধানক্ষেতে
এজন্য আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ তিনিই এ অঞ্চলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের পথিকৃৎ। তিনিই প্রথম চালু করেছিলেন কলের লাঙ্গল, মানে ট্রাক্টর। নিজ হাতে সেই ট্রাক্টর চালিয়েছিলেন তিনি। আমাদের পতিসরে। বাংলাদেশে এখন কলের লাঙ্গলের সংখ্যা অগণিত। প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। সারাদেশে এতদিন ছোট-বড় হারভেস্টার ছিল আনুমানিক ২৪৫০টি এবং রিপার ৫০০০টি। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি যে ২০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছেন সেখান থেকে দেশে যোগ হতে যাচ্ছে আরও প্রায় ১০২৫টি হারভেস্টার এবং ৫৫০টি রিপার। এসব যন্ত্রপাতি কিনলেই কৃষক পাচ্ছেন বিরাট অংকের ভর্তুকি। হাওরাঞ্চলের কৃষকরা শতকরা ৭০ ভাগ আর অন্য অঞ্চলের কৃষকরা শতকরা ৫০ ভাগ। এসবের সাথে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে নেয়া হয়েছে মেগা পরিকল্পনা। আশা করা যাচ্ছে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের কৃষি সজ্জিত হবে নতুন রূপে। আধুনিক সব যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজবে বাংলাদেশের কৃষি।
Advertisement
বর্তমানে ফেরা যাক। করোনাভাইরাসজনিত বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৩১ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তন্মধ্যে কৃষি সংক্রান্ত প্রধান নির্দেশনাটি হচ্ছে, ‘খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে, অধিক প্রকার ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। কোনো জমি যেন পতিত না থাকে’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সকল নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের জন্য এরই মাঝে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী পরামর্শ করেছেন এখাতে অভিজ্ঞজনের সাথে, জুম মিটিং প্লাটফর্মে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে আলোচনা করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, এমিরেটাস অধ্যাপক, সাবেক উপাচার্য, একাধিক সাবেক সফল কৃষি সচিব, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, কৃষি সম্প্রসারণ বিশেষজ্ঞ, বীজ বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ বীজ অ্যাসোসিয়েশন, শাকসবজি ও ফলমূল রফতানিকারক সমিতি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ফার্মস, সুপারশপ মালিক সমিতিসহ কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গের সাথে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক এসব মতবিনিময় ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে আশা করা যায়। আগামী দিনগুলোতে বীজ, সার, সেচ, ইত্যাদি কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের শর্তাবলী সহজীকরণ ইত্যাদি নানান বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সবাই গুরুত্বপূর্ণ মত দিয়েছেন। যেমন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মতে, কৃষক পর্যায়ে ধানের মূল্য নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সেচের খরচের প্রণোদনা প্রদান আবশ্যক। শুধু আলোচনা নয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে প্রণয়ন করেছে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস সারাবিশ্বকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছে, এখানে কিন্তু খাদ্যাভাব মারাত্মকভাবে দেখা দিতে পারে। আমাদের মাটি উর্বর, আমরা কিন্তু নিজেদের চাহিদা পূরণ করে অনেককে সাহায্য করতে পারব’- বাংলাদেশের কৃষি এগোচ্ছে সে পথেই।
মুশকিল হলো বাংলাদেশ চাইলেই তার প্রয়োজনীয় সকল কৃষিজ পণ্য উৎপাদন করতে পারবে না। কিছু কৃষিপণ্য আমাদের আমদানিই করতে হবে। যেমন গম। এক-দেড় মাসের শীতকালীন আবহাওয়া গম চাষের উপযোগী নয়। তাই গম চাষ এদেশে লাভজনকও নয়। যদি না জমি পতিত থাকে। শুধু গম নয়। আরও অনেক পণ্যই আমাদের আমদানি করতে হয়, ভবিষ্যতেও করতে হবে। দেশে উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত প্রধান প্রধান কৃষিজ পণ্যের একটা নাতিদীর্ঘ তালিকা দেয়া যেতে পারে।
তাছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছে প্রায় ২৬ দশমিক ৫ লাখ টন ভোজ্যতেল। রফতানি হয়েছে কিছু চা, কাঁচা পাট এবং অল্প পরিমাণের অন্যান্য কৃষিপণ্য। তথ্যচিত্র থেকে ধারণা করা যায় যে, আমাদের খাদ্যাভ্যাসে খুব বেশি পরিবর্তন না এলে আগামী বছরেও আমদানির তালিকায় থাকবে গম, ভুট্টা, তেল ও ডাল জাতীয় দানাদার শস্য, পেঁয়াজ ও মশলা। বিগত বছরগুলোতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রণোদনামূলক কর্মসূচির কারণে ভুট্টা, তেল ও ডাল জাতীয় দানাদার শস্যের উৎপাদন ছিল উর্ধ্বমুখী। এ বছর পেঁয়াজের সংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতা থেকে যোগ হয়েছে কিছু নতুন জাত। কৃষকও পেঁয়াজ উৎপাদনে উৎসাহিত হবে আশা করা যায়। উৎপাদনের গতিধারা পর্যালোচনা করলে বলা যেতে পারে আগামী বছর আমদানির তালিকার বড় অংশ জুড়ে থাকবে গম, ভোজ্যতেল এবং মশলা।
প্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশ চাইলেও সকল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে না। দরকারও নেই। কোনো দেশ তাদের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান নিজেরা উৎপাদন করে না। বর্তমানের বিশ্বায়নের যুগে পারস্পরিক সহযোগিতাই উন্নয়নের চালিকা শক্তি। তাছাড়া, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এত অল্প জমিতে সব ফসল করতে গেলে মূল খাদ্য চালই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। করোনা মোকাবিলার প্রধান হাতিয়ারও বৈশ্বিক সহযোগিতা। জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ অধিবেশনের সভাপতি তিজ্জানি মুহাম্মদ-বান্দে যেমন বলেছেন, “Moving forward, I encourage all Member States to leverage South-South and Triangular Cooperation in order to strengthen agricultural systems”.
কৃষিতে করোনার প্রভাব মোকাবিলার জন্য সবাইকে সমভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। আইএফপিআরআই তাদের এক প্রতিবেদনে কোভিড -১৯ উদ্ভূত পুষ্টি সংকট মোকাবিলা করার জন্য কৃষিকেন্দ্রিক সাপ্লাই চেইন এবং ভ্যালু চেইনের সাথে সামাজিক দূরত্ব প্রয়োগ এবং স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাগুলি উন্নত করার উপর জোর দিয়েছে। খামার থেকে শুরু করে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সকল প্রকার বাজার ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখার তাগাদা দিয়ে বলেছে, ‘Keep domestic and international food markets working’.
মুশকিল হলো, বাংলাদেশে কৃষির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই বাজার ব্যবস্থাপনা। আগেও ছিল, এখনো আছে। দুর্বল ব্যবসায়িক নৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কৃষিজ বাজার। সকালের ৫০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ বিকেলে হয়ে যায় ১৮০ টাকা। আবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সন্ধ্যায় নেমে আসে ১০০ টাকায়। ওয়াজ-নসিয়ত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার নজির পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। যদিও কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ দেখাশোনা করার জন্য আছে কৃষি বিপণন অধিদফতর। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। নচেৎ কৃষককে বারংবার হোঁচট খেয়েই যেতে হবে দোদুল্যমান বাজার ব্যবস্থার কাছে।
এখানে অবশ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের আশার আলো দেখায়। গত বছর থেকে অনলাইন অ্যাপসের ব্যবহার করা হয়েছে প্রকৃত কৃষক নির্বাচনের জন্য। পরে সরাসরি তাদের কাছ থেকে ধান কেনা হয়েছে। চারদিকে প্রশংসিত হয়েছে সরকারের এই উদ্যোগ। করোনাকালেও যোগ হয়েছে চমৎকার কিছু আইডিয়া। যেমন ত্রাণের উপকরণে যোগ হয়েছে সবজি, দুধ, ডিম, আলু। কৃষক সবজি বিক্রি করেছেন অনলাইনে, অ্যাপসের মাধ্যমে। কৃষি বাতায়ন পেয়েছে কৃষকপ্রিয়তা। জনপ্রিয় এসব ‘Food System Innovations’ এর পেছনে কাজ করেছেন মাঠ প্রশাসনের তরুণ, মেধাবী, বিচক্ষণ সরকারি কর্মকর্তারা।
অবশ্য কৃষি মানেই এখন শিক্ষিত, প্রাণচঞ্চল, সাহসী, উদ্যমী টগবগে তরুণ-তরুণীর কর্মস্থল। তাদের পদচারণায় মুখর বাংলাদেশের কৃষি। এসব যুবার হাত ধরেই দেশ আজ ফুলে-ফসলে পূর্ণ। চারদিকে চাল, ডাল, সবজি আর ফলের ছড়াছড়ি। বিস্তর মাঠে দোল খায় উচ্চফলনশীল নানান জাতের ফসল। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশের কৃষি জয়ী হবে করোনা যুদ্ধে।
করোনা মহামারি বিশ্ব সভ্যতাকে দাঁড় করিয়েছে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। নিশ্চিতভাবেই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। বিশেষ করে কৃষি অর্থনীতিতে এর প্রভাব হতে পারে অনেক গভীর। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনার যে প্রভাব, সেটা আছড়ে পড়তে পারে বাংলাদেশের কৃষিতে। আবার একমাত্র কৃষিই হতে পারে বাংলাদেশের সামষ্ঠিক অর্থনীতির চালিকা শক্তি। করোনা মোকাবিলার হাতিয়ার। তাই কৃষি খাতের যত্ন নিতে হবে শতভাগ আন্তরিকতা দিয়ে। গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে নিখুঁতভাবে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ৭ কোটি ৮০ লাখ মানুষের জন্য এ দেশের কৃষক উৎপাদন করত ১০০ লাখ টন চাল। ছিল অভাব, হাহাকার। টাকা দিয়েও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনা যেত না চাল। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এক সভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান আফসোস করে বলেছিলেন, ‘দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেই আমি চাউল কিনতে পারছি না। চাউল পাওয়া যায় না। যদি চাউল খেতে হয় আপনাদের পয়দা করেই খেতে হবে’। সেই বাংলাদেশ এখন চালে উদ্বৃত্ত। দেশ থেকে নেই হয়ে গেছে মরা কার্তিক। পালিয়ে গেছে মঙ্গা, খিদা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশের কৃষকেরা পয়দা করে চলেছেন ধান, ভুট্টা, সবজি, ফল। লাখ লাখ টন।
আন্তর্জাতিক বাজার আবারও অস্থিতিশীল হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আসন্ন এই সংকট মোকাবিলায় মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে নিরলস; ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনাকে শিরোধার্য করে। নিশ্চয় একদিন করোনার আঁধার দূর হয়ে বাংলাদশের আকাশে উঠবে নতুন সোনালী সূর্য। আর সেদিন আমরা গেয়ে উঠব:
আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ।।
লেখক উপ-সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়ইমেইল : monsuralamkhan@gmail.com
এইচএ/এমআরএম