করোনাভাইরাসের সংকট মোকাবিলায় শুরু থেকে জীবানুনাশক ছিটানো, আইসোলেশন, হোম কোয়ারেন্টাইন ও লকডাউন ব্যবস্থা কার্যকর, মৃত ব্যক্তির জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণ এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ নানা কার্যক্রমে সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে পুলিশ। এখন পুলিশেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। এমন অবস্থায় একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছেন পুলিশ সদস্যরা। যাদের মধ্যে একজন কনস্টেবল বাহাউদ্দিন। করোনায় আক্রান্ত সহকর্মীদের সেবায় তার ভূমিকা অনন্য। তিনি একাই আক্রান্ত ৮০ জন পুলিশ সদস্যকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়েছেন।
Advertisement
করোনাকালেও অকুতোভয় এ পুলিশ সদস্য নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে সহকর্মীদের সেবায় এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছেন। মানবপ্রেমী এই পুলিশ সদস্য ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম-উত্তর) বিভাগের মেডিকেল সহকারী।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে আনা-নেয়াসহ তাদের সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি হাসিমুখে।
করোনার উপসর্গ নিয়ে বিপর্যস্ত, কিংবা বেশি দুর্বল হয়ে পড়া পুলিশ সদস্যদের তিনি নিজের কাঁধে তুলে নামিয়েছেন বহুতল ভবন থেকে। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে গেছেন হাসপাতালে।
Advertisement
অবাক হলেও সত্য যে, করোনা রোগীর সংস্পর্শে যাওয়ায় নিজেও পরীক্ষা করেছেন ২০১৫ সালে কনস্টবল পদে যোগদান করা বাহাউদ্দিন। কিন্তু ফলাফলে করোনা নেগেটিভ এসেছে তার।
করোনার ভয়কে জয় করা কনস্টেবল বাহাউদ্দিন বলছিলেন, 'প্রথমদিকে করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের কাছে যেতে খুব ভয় পেতাম। পরিস্থিতি দেখে খুব খারাপ লাগছিল। করোনার কারণে দেশের এই চরম সংকটে পুলিশ সদস্যরা বুক চিতিয়ে নেমেছে। নানামুখী তৎপরতায় ব্যস্ত প্রত্যেক পুলিশ সদস্য। সেখানে আমার পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হয়নি।'
তিনি বলেন, 'আমি বাংলাদেশ পুলিশের একজন গর্বিত সদস্য। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমার পুলিশের লোকজন যখন ব্যাপকহারে ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছিলেন, তখন আমার মন থেকে সব ভয় দূর হয়ে যায়। আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারিনি।'
করোনা আক্রান্ত পুলিশের সেবায় নিজের আত্মনিয়োগের কারণ ব্যাখ্যা করে এই কনস্টবল বলেন, 'আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার বাবা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। আমিও দেশের ডাকে করোনাযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছি।'
Advertisement
বাহাউদ্দিন জানান, তিনি যথারীতি স্বাস্থ্যবিধি মেনে, পিপিই ও মাস্ক পরিধান করেই আক্রান্তদের সেবা করে যাচ্ছেন।
'মানবসেবা শ্রেষ্ঠতম কাজ। পুলিশ সদস্যদের সেবায় মারা গেলে আমি শহীদের মর্যাদা পাবো',- বলেন তিনি।
তার বিষয়ে ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রহিমা আখতার লাকি বলেন, বাহাউদ্দিন যা করেছেন তা রূপকথাকেও হার মানায়। বাহাউদ্দিনের সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতা শিক্ষণীয় অনুকরণীয়। একটা বাচ্চা ছেলে হয়েও তিনি যে মাপের সাহসিকতা প্রদর্শন করে করোনা আক্রান্ত পুলিশের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন, তা বর্ণনাতীত।'
তিনি জানান, হোটেলে করোনা উপসর্গ নিয়ে যারা রয়েছেন সেসব পুলিশ সদস্যদেরও হাসপাতালে আনা-নেয়া, ওষুধ পথ্য দিয়ে সেবা করা, নিয়মিত খোঁজখবর রাখাসহ তিনি সার্বিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নীরবে, সযত্নে।'
দেশে সবশেষ মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২৩৯ জন পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হন, যা এ যাবৎ ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চসংখ্যক আক্রান্তের সংখ্যা। সবমিলে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ১,১৫৩ জন পুলিশ সদস্য। আর করোনাযুদ্ধে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৫ পুলিশ সদস্য।
সারাদেশের পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের তথ্য উপাত্ত থেকে জানা গেছে, পুলিশে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে আইসোলেশনে রয়েছেন ৩১৫ জন এবং আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসায় ১,২৫০ জন কর্মকর্তাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৮৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
সোমবারের হিসেব অনুযায়ী শুধু ঢাকা মহানগর পুলিশেই (ডিএমপি) ৪৪৯ জন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত। তবে আক্রান্তদের মধ্যে মাঠপর্যায়ের সদস্যই বেশি।
ডিএমপি জানায়, করোনায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও তাদের দুজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ও একজন সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত জীবন দেয়া ৫ পুলিশ সদদ্যের মধ্যে চারজন ডিএমপির, একজন এসবির।
তারা হলেন, ডিএমপির কনস্টেবল জসিম উদ্দিন (৪০), এএসআই মো. আব্দুল খালেক (৩৬), ট্রাফিক বিভাগের কনস্টেবল মো. আশেক মাহমুদ (৪৩), পিওএমের এসআই সুলতানুল আরেফিন এবং পুলিশের বিশেষ শাখার এসআই নাজির উদ্দীন (৫৫)।
জেইউ/জেডএ/পিআর