১. দেশে করোনাকাল চলছে। সকলের দৃষ্টি এখন করোনার দিকে। এরই মধ্যে বেড়েছে মশার উৎপাত। আর এ সময়ে মশা মানেই ডেঙ্গুর প্রকোপ। সারাদেশে ইতোমধ্যেই প্রায় ২০০ ডেঙ্গুরোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সময় বিবেচনায় রোগীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় প্রায় চারগুণ। গত বছর প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং ১৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
Advertisement
গত বছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর- এই তিন মাস ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। আর এ বছর এপ্রিলেই দেশে ডেঙ্গুরোগীর ছড়াছড়ি। এভাবে বাড়তে থাকলে আগামী ভরামৌসুমে (তিন মাস পর) অবস্থা খুবই ভয়াবহ হতে পারে। এ বছর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। করোনারোগী নিয়েই আমাদের হাসপাতালগুলো ও চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। এর মধ্যে যদি ডেঙ্গুরোগী বেড়ে যায় তা হবে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো অবস্থা। তাই আমাদের মশা নিয়ে ভাবতে হবে এখনই। করোনাদুর্যোগের এই সময়ে ডেঙ্গুুর প্রতিকার নয় বরং করতে হবে মশার শক্ত প্রতিরোধ। কর্তৃপক্ষকে মশা নিয়ন্ত্রণে এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
২. সারাদেশে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় মশা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করেছে। গত বছর বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ডিম পেরে রেখেছিল মশা আর সেগুলো ফুটে এখন লার্ভা বেরুচ্ছে। পর্যাপ্ত পানির অভাবে মশার ডিমগুলো এতদিন ফুটতে পারেনি। তাই এই বৃষ্টির পানি যেখানেই (পরিত্যক্ত টায়ার, পানির ট্যাংকি, বালতি, টব, গাছের গুঁড়ির ফাঁকা জায়গা, আবদ্ধ নালা ইত্যাদি) জমা থাকছে সেখান থেকে দুই-তিন দিনেই জন্ম নিচ্ছে মশার লার্ভা এবং ৮-১০ দিনে হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ মশা। আর এখনকার লার্ভাগুলো থেকে যেসব পূর্ণাঙ্গ মশা হচ্ছে তাদের ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করার সম্ভাবনা থাকছে (ভার্টিকাল ট্রান্সমিসন পদ্ধতিতে অর্থাৎ মশা থেকে মশা)।
আর এভাবেই মশার মাধ্যমে মানুষের দেহে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়। তাই এ সময়ে মশা দমন (বিশেষ করে লার্ভা) জরুরি। নচেৎ ডেঙ্গু ভাইরাস আগামী দুই-তিন মাস পর মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে (হরাইজন্টাল ট্রান্সমিসন পদ্ধতিতে অর্থাৎ মশা থেকে মানষু কিংবা মানুষ থেকে মশা)। তখন শত চেষ্টা করেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। যেটা গত বছর হয়েছিল। তাই কর্তৃপক্ষকে মশার কার্যকর দমনে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
Advertisement
৩. বৈশ্বিক কোভিড-১৯ দুর্যোগে দেশ মূলত এখন লকডাউন অবস্থায় আছে। তাই সরকারি-বেসরকারি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান, অফিস, বিল্ডিং, স্থাপনা বা পরিত্যক্ত স্থান বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও তালাবদ্ধ। তাই এসব জায়গায় মশা এবং এর লার্ভা নির্বিঘ্নে জন্ম নেয়ার সুযোগ পাবে। সুতরাং এসব জায়গায় কর্তৃপক্ষকে এখনই বিশেষ নজর দিতে হবে।
তাছাড়া করোনার এই সময়ে আমাদের বেশিরভাগ সময় বাসাতেই থাকতে হচ্ছে এবং এতে মশারাও আমাদের কামড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে বেশি। করোনাকাল দীর্ঘ হলে এই সুযোগ আরও বাড়বে এবং ডেঙ্গুর ঝুঁকিও বাড়বে। মশা করোনাভাইরাস না ছড়ালেও ডেঙ্গু ঠিকই ছড়াবে। তাই আমাদের মশা থেকে সুরক্ষিত রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
৪. আশার কথা হচ্ছে এ বছর মশা নিয়ন্ত্রণে সরকার আগাম ভাবতে শুরু করেছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষও সজাগ আছে। মিডিয়াও যথারীতি সোচ্চার। গত বছর মিডিয়া ডেঙ্গু মহামারি নিয়ে ব্যাপক কাভারেজ দিয়েছিল। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে মিডিয়াগুলোকে আরও বেশি সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে বৃষ্টির পানি জমতে না দেয়া বা লার্ভা না জন্মানোর ব্যাপারে। কারণ ডেঙ্গুর আগ্রাসন ঠেকাতে মশা নিয়ন্ত্রণ পূর্বশর্ত। ঠিকমতো মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গুর মহামারি ঠেকানো যাবে না।
সরকারের পাশাপাশি আমাদেরকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই মশাকে রুখতে হবে। তবে মশা সামলাতে গিয়ে করোনার কথা ভুলে গেলে মহাবিপদ হবে। কার্যকরী ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত এ ধরনের ভাইরাসের সাথে যুদ্ধটা হয়তো আরও অনেকদিন আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।
Advertisement
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
এইচআর/বিএ/জেআইএম