নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে রোমান্টিক হিরো হিসেবে ঢাকাই চলচ্চিত্রে চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদের অভিষেক ঘটে। এরপর চমৎকার অভিনয় দিয়ে দুই বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। বিশেষ করে দুই বাংলার যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন ফেরদৌস। জনপ্রিয় এই অভিনেতা জানালেন রোজা নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা। জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-
Advertisement
জাগো নিউজ : প্রথম রোজা কত সালে রেখেছিলেন মনে আছে?ফেরদৌস : যতদূর মনে পড়ে তখন ক্লাস কেজি ওয়ানে পড়তাম। একদম ছোটবেলা থেকেই আমি রোজা রাখার চেষ্টা করি। ছয় সাত বছর বয়স হবে তখন। প্রথম যেদিন রোজা রাখলাম, বড় ভাই ও আম্মা দুপুরবেলায় খেয়ে ফেলতে বললো। আমিও খুব ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম। আমি বিছানায় শুয়ে আছি। আমার চারপাশে ভাইবোনেরা বসে আছে।
খুব কষ্টের রোজা ছিল আমার। এরপরেও আমি খাইনি। এখনও আম্মা বলে কষ্ট করে যারা রোজা রাখে তাদের ভেতরটা শক্ত হয়। আমি সবসময় রোজা রাখি। বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া আমি রোজা ভেঙেছি বলে আমার মনে পড়ে না। এটা বড় ইবাদতের অংশ, এটা একটা আত্মশুদ্ধির ব্যাপার।
জাগো নিউজ : শুটিংয়ে তো প্রচুর পরিশ্রম হয় বলে, অনেকেই রোজা ছেড়ে দেন, আপনার ক্ষেত্রে কী তেমন হয়েছে কখনো?ফেরদৌস : আমি চেষ্টা করি রোজার মাসে শুটিং না রাখতে কম কাজ করে যতটুকু সময় এবাদত এর মধ্যে কাটানো যায়। এক মাস রোজা রাখার মাধ্যমে শরীরের অনেক জটিলতাও দূর হয়ে যায়।
Advertisement
জাগো নিউজ : ছোটবেলায় যখন রোজা রাখতে চাইতেন কিন্তু সেহরির সময় আপনাকে ডাকা হতো না, এমনটা হয়েছে কখনো?
ফেরদৌস : এই এরকম প্রচুর হয়েছে। আমাকে যখন ঢেকে দিত না, তখন আমি না খেয়ে রোজা রাখতাম। এরপর আমাকে ডেকে দিত। আমাকে ডেকে দিতে গিয়েও বিপদ হতো, কারণ আমার গভীর ঘুম। যখন আমাকে বলতেছে, না খেলে কিন্তু রোজা রাখতে পারবা না। তখন আমি হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়তাম।
জাগো নিউজ : কেমন ছিল সেসব দিনগুলো?ফেরদৌস : একটা ব্যাপার আমার খুব মনে পড়ে। ক্লাস ওয়ান কিংবা টুতে পড়ি। শীতকালে রোজা হচ্ছে। সেহরির সময় আম্মা গরম খাবার রান্না করত। সে খাবারের গন্ধটা এখনও নাকে লেগে আছে। আর কোনো খাবারের মধ্যে পায় না সেই ঘ্রাণটা। আজীবন মায়ের হাতের সেই রান্নার স্মৃতি মনে থাকবে। শীতের মধ্যেও আম্মা ঘুম থেকে উঠে গরম খাবার তৈরি করতেন।
আমরা সবাই লেপমুড়ি দিয়ে বসে আছি, ওই সময় আম্মার গরম খাবার পরিবেশন করা। আহা কী দারুণ ছিলো দিনগুলো। বাবাকে ঘিরেও একটা মজার ঘটনা আছে রোজার।
Advertisement
জাগো নিউজ : বলবেন সেই গল্পটা?ফেরদৌস : যখন একটু বড় হলাম ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ি। আমাদের ক্যান্টনমেন্টের বাসার পেছনে একটা কল ছিল। একদিন আমার প্রচণ্ড পিপাসা লেগেছে দুপুরবেলায়। মুখ ধুতে গিয়ে কলে একটু পানি খেয়ে ফেলেছি।
ইফতারের সময় যখন ইফতার করতে বসেছি, সেই সময় আব্বা বলল, বাইরে যে কলটা আছে এ কল দিয়ে কিন্তু টেংরা মাছ বের হয়। আব্বা বললো তুমি যদি ওই কলের পানি খেয়ে ফেলো পেটের ভিতর টেংরা মাছ গেলে তখন বুঝবা! টেংরা মাছটা পেটের ভিতর বাচ্চা দিবে। এগুলো পেটের ভিতর অনেক বড় হবে। আমি ভাবতে শুরু করলাম এই প্রক্রিয়াটা হতে কতদিন লাগবে। হাহ হাহ হা হা হা।
পরে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। বাইরের ওই কলের পানি যেন আমরা না খায়, রোজা রেখে তো খাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ জন্য এটা বাবা বলেছিলেন।
জাগো নিউজ : আপনার বাবা কীভাবে জানলো আপনি পানি খেয়েছেন দুপুরে?ফেরদৌস : ওটা হয়তো বাবা অনুভব করেছে কিংবা দেখে নিয়েছে। বাবা মায়েরা তো এভাবেই ছেলেমেয়েদের অপকর্ম বুঝে ফেলে। একটা সিংক কাজ করে ভেতরে। আমার মেয়েরা যখন দেখি কোন উল্টাপাল্টা করছে। তখন কিন্তু আমি বুঝে ফেলি। এটা বাবা মায়ের একটা আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা।
এখন আমার দুই মেয়ে রোজা রাখতে চাই। আমার ছোট মেয়ে নামিরা ক্লাস টু তে পড়ে। এইবার আমার সঙ্গে ও রোজা রাখল। শবে বরাতের রোজাও রেখেছে। আমার মনে হয় বাবা মার কাছ থেকে আমরা যেটা শিখেছি এটা যেন আমাদের সন্তানদের ভিতর দিয়ে যেতে পারি।
বাবা-মা আমাদের সবাইকে নিয়ে সেহরি খেতে বসতেন আবার ইফতারের সময় আমরা সবাই একসঙ্গে প্রকার করতাম ওই জিনিসটাই এখন আমি আমাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে করি
জাগো নিউজ : এবারের রোজা টা একটু অন্যরকম ভাবে কাটছে আমাদের এমন পরিস্থিতিতে আমরা কখনোই পড়িনি এবারের রোজা কীভাবে কাটছে?
ফেরদৌস : রমজানের যে প্রকৃত মাহাত্ম্য। এইবার কিন্তু আমরা সঠিকভাবে সেগুলো পালন করতে পারছি। সারাক্ষণ নানারকম এবাদত এর মধ্যে থাকতে হবে, দান করতে হবে, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে, এগুলো কিন্তু এবার সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব।
আমরা যে জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যেমন, আগের বছরগুলোতে অনেকদিন রাস্তার মধ্যে ইফতার করছি জ্যামে। কারণ এ সময়টা প্রচন্ড জ্যাম হয়। রাস্তায় ইফতার করলে কিন্তু পরিবারের সঙ্গে ইফতারির আনন্দটা পাওয়া যায় না।
করোনাভাইরাসের আমরা যতই নেগেটিভ দিকে দেখি না কেন এটা একটা পজিটিভ ব্যাপার। আমরা ঘরে বসে সুন্দরভাবে রমজানটা পালন করতে পারছি। আজকাল এমন অনেক মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা বলি যাদের সঙ্গে কয়েক বছর কোন রকমের যোগাযোগ হয়নি। সেই মানুষগুলো আমার আপন। এমন এমন মানুষের খবর নেয়া হচ্ছে যাদের খবর অনেকদিন নেওয়া হয় না।
জাগো নিউজ : এবারের রোজায় আর কী কী ব্যতিক্রম হচ্ছে?ফেরদৌস : এবার যেটা করছি। অন্যান্য বার সেটা করা হয়ে ওঠে না। দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে বাঁচার গিয়ে দ্রুত জিনিসপত্র কেনাকাটা করে সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। এতদিন মনে হয়েছে এগুলা জাস্ট করার জন্য করা। আমার আশে পাশের অনেক লোকজনকে ও আমার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আমি খাবার সামগ্রী উপহার পাঠিয়েছি। তারা অনেক খুশি হয়েছে আমার অনেক ভালো লেগেছে।
একটা মানুষ তো আট ঘণ্টার বেশি কাজ করা সম্ভব না, করা উচিতও না। আমরা কিছু সময় কাজ করি বাকি সময়টা কিন্তু অকাজে নষ্ট করি। ঘরে বন্দী থেকে উপলব্ধি করতে পারছি বিষয়টা। প্রকৃতিও কিন্তু একটু শ্বাস নিল। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে এবারের রমজানটা আমাদের বদলে দিতে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে।
জাগো নিউজ : যেমন এবারের রমজান নিজেদের বদলাতে কী কী ভূমিকা রাখছে বলে মনে হচ্ছে আপনার?ফেরদৌস : আমরা যারা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স আর মেন্টাল ডিসটেন্স বুঝিনা। সামাজিক ও মানসিক দূরত্ব বুঝি না। এটা আমরা বুঝতে শিখলাম। সামাজিক দূরত্ব ও মানসিক দূরত্ব কিন্তু এক না। আমরা কয়জন কয়বেলা হাত ধুয়ে খেতে বসি। নিয়ম করে হাত ধুতে হয়। এটা তো সবার জন্যই করা উচিত। এগুলো আমরা নতুন করে শিখলাম। এগুলো সুন্দরভাবে পালন করতে পারলে অনেক ফায়দা। যার একান্ত প্রয়োজন সেই শুধু বাইরে যাচ্ছে। যার প্রয়োজন নেই সে বাইরে যাচ্ছে না। এইভাবে আমরা পুরো দেশটাকে মহামারী থেকে রক্ষা করার দিকে এগিয়ে যাব।
জাগো নিউজ : রোজায় ধর্মীয় চর্চাও বাড়ে, এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?ফেরদৌস : এবার রোজায় নিজের জীবনটাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিতে পারব আমরা। আগামীর জীবনের জন্য যা কাজে লাগবে আগামীতেও। রোজার মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারছি। আমার বলতে দ্বিধা নাই আমি অনেক বছর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িনি। মানে বিভিন্ন কারণে পড়া হয়নি। এইবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারছি।
অনেকের সঙ্গে কথা হয় আমার, যারা কখনোই রোজা রাখত না। তারাও কিন্তু এবার রোজা রাখছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে। আমার বড় ভাই রোজা রাখতে পারত না। আমাকে ফোন করে বলল সে রোজা রাখছে এবং নামাজ পড়ছে। শুনে মনটা অনেক ভালো হলো আমার। এখন প্রত্যেকেই নিজের জীবনটাকে অন্যরকম করে দেখছে। আমরা যারা বেঁচে থাকব, এই শিক্ষাটাই আমাদের ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
জাগো নিউজ : করোনাভাইরাস আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে?ফেরদৌস : ছোটবেলা থেকেই কিন্তু আমাদের অনেক নিয়ম-কানুন শেখানো হয়। আমরা স্কুলে কেন যায়? নিয়ম শেখার জন্য। কিন্তু সেই শিক্ষাগুলোকে আমরা ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগায় না। আমরা বিপদে পড়ি আবার বিপদমুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এইবার যে বিপদে পড়েছি সেই বিপদটা সেইরকম না। কয়েক মাস ধরে এই বিপদের ভেতর আছি আমরা। আবার এটা শুধুমাত্র আমার কিংবা তোমার একার না সারা পৃথিবী এই বিপদের মধ্যে আছে।
আগে ঢাকায় একটা বিপদ হলে মানুষ অন্য জেলায় চলে যেত। বাংলাদেশ কোন বিপদ হলে মানুষ অন্য দেশে চলে যেত। এবার কোথায় যাবে? এবার নিজের জায়গাতেই থাকতে হবে এবং নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে।
জাগো নিউজ : এবার একটু অন্য প্রসঙ্গ, সাধারণত ইফতার সেহরিতে কোন ধরনের খাবার খান?ফেরদৌস : আমি ইফতারে ভাজাপোড়া তেমন পছন্দ করি না। এটা ছোটবেলা থেকেই। এরপর যখন অভিনয় শুরু করলাম, তখন আরও সচেতন ভাবেই ভাজা পোড়া এভয়েড করে চলি, নিজের স্বাস্থ্যের জন্য, সৌন্দর্যের জন্য ভাজা পরিহার করা উচিত। আমি খুব সাধারন সেহরি ইফতার করি।
ডিম, ফল, খেজুর, রুটি খাই সন্ধ্যায়। আবার সেহেরীর সময় চিড়া, কলা খাই। আমি যদি সারাদিন রোজা রেখে ইফতারে জমকালো খাবার খাই, বিরানি খাই তাহলে কী হলো! এখন আমাদের সবাইকে হিসাব-নিকাশ করে চলা উচিত। এখন অনেক অযাচিত খাবার না খেয়ে সে খাবার যদি মানুষকে দিতে পারি সেটা ভালো।
জাগো নিউজ : এবারের রোজার বিশেষ প্রার্থনা কি?
ফেরদৌস : আমার মনে হয় আমাদের প্রত্যেকের মনের ভেতর ভালবাসাটা যেন আরেকটু বাড়ে। এই ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করা যায়। ভালোবাসা দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায়। আমাদের অনেক সম্প্রীতির অভাব। আমরা ভালবাসাটাকে অনেক বেশি মেকানিকাল করে ফেলি। আর্টিফিশিয়াল করে ফেলি। সত্যিকারের ভালোবাসা যদি থাকে। সেই ভালোবাসা দিয়ে আমি নিজেও ভালো থাকতে পারি অন্য কেউ ভালো রাখতে পারি।
এমএবি/এমকেএইচ