জানুয়ারির শেষ দিকে নাড়ির টানে দেশে ফিরেছিলেন সৌদি প্রবাসী সেকান্দার হোসেন (৪৫)। কে জানত, এই ফেরাই তার শেষ ফেরা হবে? যে দেশের টানে ফিরেছিলেন, সেই দেশেরই চরম অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হবে তাকে?
Advertisement
প্রায় ১৫ দিন আগে হাল্কা জ্বর হয়েছিল তার। এরপর আবারও জ্বর, সঙ্গে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন বন্দরনগরের এনায়েত বাজার এলাকার বাসিন্দা প্রবাসফেরত সেকান্দার হোসেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার নগরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সবার এক কথা, করোনা রিপোর্ট নিয়ে আসেন। তাই বাধ্য হয়েই আইইডিসিআর (রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) থেকে ফোনে পাওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করছিলেন।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার তার অবস্থার অবনতি হতে শুরু করলে চট্টগ্রামে করোনার জন্য ডেডিকেটেড জেনারেল হাসপাতালেও যোগাযোগ করেন এই প্রবাসীর পরিবার। দেন তার নমুনা। কিন্তু করোনার সব উপসর্গ থাকার পরেও হাসপাতাল থেকে তাকে বাসায় অবস্থানের পরামর্শ দেয়া হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, করোনার রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।
Advertisement
তার নমুনা সংগ্রহের চারদিনেও রিপোর্ট হাতে পায়নি পরিবারটি। কিন্তু আজ সেই রিপোর্টের আর প্রয়োজন নেই। সোমবার (৪ মে) সকাল ৭ টার দিকে নিজ বাসায় ধুকতে ধুকতেই মারা গেছেন এই রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
তবে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তির ভাগ্য না হলেও এখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সেকান্দার হোসেনকে দাফন করতে হবে করোনা রোগীর নিয়ম অনুসরণ করেই! এ যেন নিঠুর ভাগ্য। জীবৎকালে চিকিৎসা না পেলেও মৃত্যুর পর মিলছে রাষ্ট্রীয় আদেশ!
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আমাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, মৃত ব্যক্তিকে চট্টগ্রামে দাফন করতে হলে অবশ্যই করোনা সতর্কতা মেনেই করতে হবে। এর বাইরে কিছু করতে হলে, করোনা রিপোর্ট হাতে আসতে হবে।’
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি জাগো নিউজকে বলেন,‘ আমরা কী করব বলেন, সাত দিন আগের রিপোর্ট মিলছে না বিআইটিআইডি (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস) থেকে। এখন অবশ্য আমি বলেছি, এই ব্যক্তির রিপোর্টটা আগে দেয়ার জন্য। দেখি তারা কী করতে পারেন। এখন দাফন করতে চাইলে শুধু চারজনে মিলে করবেন। পুলিশ প্রশাসন সহায়তা করবে। বাড়ির বাকিদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।’
Advertisement
মৃত সেকান্দারের শ্যালক সালমান ফারুকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ৩১ জানুয়ারি দেশে ফিরেছিলেন আমার দুলাভাই। প্রায় ১৫ দিন আগে হাল্কা জ্বর হয়, সেটা আবার সেরেও গিয়েছিল। পরে আবারও জ্বর হয়, সঙ্গে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। ওই সময় আমারা বেশ চেষ্টা করেও সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই তাকে ভর্তি করাতে পারিনি। সবার কথা ছিল, আগে করোনা রিপোর্ট, তারপর ভর্তি। অনেক উপর (প্রভাবশালী) থেকেও চেষ্টা করা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘শেষমেষ গত বৃহস্পতিবার জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসেন। ওই সময় আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তির অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু সেখানে সিট খালি না থাকায় হাসপাতাল ভর্তি নেয়নি। বরং আমাদের রোগীকে বাসাতেই চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। তখন আমরা চেষ্টা করেছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করোনার রিপোর্টটি হাতে পেতে। তাহলে অন্তুত হয় করোনা হাসপাতাল, নয় সাধারণ কোনো হাসপাতালে ভর্তি করানো যেত। কিন্তু সিভিল সার্জন মহোদয় জানালেন, এক সপ্তাহের আগে সে রিপোর্ট আসবে না। তাই হাসপাতালে ভর্তি করা যায়নি।’
‘শুধু কী হাসপাতাল! আজ যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন, তখন ৩৩৩ হটলাইনে ফোন করে একটি অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলাম। একটি অ্যাম্বুলেন্স এসেছিলও। কিন্তু উপসর্গের কথা জেনে নিয়ে যায়নি। চালক জানায়, পুলিশের নাকি মানা আছে। পরে আবারও ৩৩৩ তে ফোন দিলাম। তখন জানানো হলো, এই উপসর্গের রোগীকে কেউ নিয়ে যাবে না। আপনারা নিজেরাই ব্যবস্থা করেন! কিন্তু রাস্তায় নেমে একটি রিকশাও পেলাম না। শ্বাষকষ্টে মুখটা নীল হয়ে উঠেছিল আমার দুলাভাইয়ের। পরে সেখানেই মারা গেলেন,’- বলেন অসহায় সেই আত্মীয়।
মুঠোফোনে কান্নারত সালমান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, ‘এ কেমন রাষ্ট্র? একটা নমুনা পরীক্ষার ফল আসতে লাগে এক সপ্তাহ! এখন যদি রিপোর্ট আসে তাহলে দেখা যাবে, পরিবারের সবাই হয়তো করোনায় আক্রান্ত। আর যদি তিনি করোনা নেগেটিভ হয়ে থাকেন, তাহলে মানুষটা বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেলেন। এই কষ্ট কী করে ভুলবো আমরা ...।’
জেডএ/এমকেএইচ