জাতীয়

'কোথায় নেই পুলিশ?'

'আইন-শৃংখলা রক্ষার পাশাপাশি, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন কিংবা ঘরে থাকা বাস্তবায়ন, সামাজিক দূরত্ব প্রতিপালন নিশ্চিতের প্রচেষ্টা, নিজস্ব অর্থায়ন এবং সমাজের দয়াবান মানুষদের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে ও গোপনে ত্রাণ পৌঁছানো, আটকেপড়া মানুষের ঘরে বাজার পৌঁছে দেয়া, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে হাসপাতালে পাঠানো, অবিবেচক ভাড়াটিয়া কিংবা প্রতিবেশীদের কবল থেকে চিকিৎসাকর্মী ও করোনা রোগীকে পরিত্রাণ দেয়া, এমনকি করোনাতে মৃত্যু কিংবা করোনা সন্দেহে মৃতদেহের সৎকার- কোথায় নেই পুলিশ। বঙ্গবন্ধু মনে হয় এরকম পুলিশই চেয়েছিলেন।' 

Advertisement

 পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামের ফেসবুক পোস্টের একটি প্যারা এটি। পোস্টে নিজের শৈশব থেকে পুলিশে যোগদান, পুলিশের ভুমিকা, পুলিশের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তিনি। 

শুক্রবার (১ মে) রাতে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে পোস্টটি দেয়ার পর মুহূর্তেই ভাইরাল হয় এটি৷ পাঠকদের জন্য পোস্টটি হুবুহু তুলে ধরা হল। 

মনিরুল ইসলামের ফেসবুক পোস্ট

Advertisement

স্কুলে পড়াকালীন স্বপ্ন ছিল ভবিষ্যতে ডাক্তার হবো। আমার মা প্রায় সারা বছরই অসুস্থ থাকতেন, ডাক্তার দেখাতে হতো সেটি হয়তো একটা কারণ। অন্য কারণ মনে হয়, ওই সময়ে পড়া অনেক গল্প উপন্যাসের নায়ক ছিলেন ডাক্তার। গ্রামের স্কুলের ভালো ছাত্র ছিলাম, বরাবরই ক্লাশে ফার্স্ট হতাম। স্কুলের পরম্পরা হিসাবেই ক্লাশের প্রথম দশজনের অধিকাংশই বিজ্ঞান শাখায় চলে যেত। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না, বিজ্ঞান শাখায় চলে গেলাম, ডাক্তার হওয়ার প্রথম সিঁড়িতে পা দেয়া আরকি। যখন দশম শ্রেণিতে উঠলাম তখন আমার এক প্রিয় শিক্ষক সাহিত্য সম্পর্কে নানা উস্কানি দিতে থাকলেন। একে তো কোমল মতি, তারপর ছোটবেলা থেকেই নভেল নাটক পড়া কিছুটা ইঁচড়েপাকা গোছের স্বাধীন ছেলে। তাই দশম শ্রেণির মাঝামাঝি গিয়ে ঘোষণা দিলাম, বিজ্ঞান শাখায় আর না, মানবিক শাখায় পড়বো। যেই কথা সেই কাজ, উস্কানি দাতা শিক্ষক বললেন যে, এই সময়ের মধ্যেই তুমি কাভার করতে পারবে কোনো অসুবিধা হবে না। বিপুল উৎসাহে মানবিক শাখার বিষয়গুলো পড়তে শুরু করে দিলাম। শেষ পর্যন্ত হলো না, বিজ্ঞান শাখার প্রিয় শিক্ষকের অনুরোধে বিজ্ঞানেই রয়ে গেলাম। তবে বেশিদিন নয়, এসএসসির পরে ঠিকই ঢাকা কলেজে মানবিকে ভর্তি হলাম। ইংরেজির শিক্ষক হবো ভেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ইংরেজিতে অনার্স পড়তে থাকলাম। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত শিক্ষক না হয়ে পুলিশ হওয়ার ইচ্ছা জাগলো। কেন, তা নিয়ে ভেবে যেসব যুৎসই কারণ খুঁজে পাই তার মধ্যে প্রধান তিনটা কারণ খুব প্রশংসা প্রাপ্তির মত না। প্রথমতঃ আমার এলাকার অনেক মানুষ এক সময় পুলিশে চাকরি করতো যাদের সঙ্গে ঢাকায় প্রায়ই দেখা হতো। তারা কেউই কোনো বড় পদে ছিল না, তবে বড় পদের নানা মাহাত্ম প্রচার করে পুলিশে যোগদানের পরামর্শ দিতো।

দ্বিতীয়তঃ সূর্যসেন হলের যে রুমে আমি থাকতাম তার পাশের রুমের বাসিন্দার সঙ্গে অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী বহিরাগত একজন দ্বাদশ বিশেষ বিসিএসে পুলিশে নির্বাচিত হওয়ার পর হলে তার কদর বেড়ে যাওয়াটা চোখের সামনে দেখেও লোভ হয়েছিল। 

তৃতীয়তঃ ছাত্র থাকাকালীন এক সিনিয়র ফ্রেন্ড আর আমাদের এক ক্লাশমেটের মধ্যকার প্রেমের পরিণতিতে বিয়ের বরযাত্রী হিসেবে যোগদান। ঐ ক্লাশমেটের ভাই ও ভাবি-দু’জনই তখন ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশে এডিসি হিসেবে কর্মরত। রাজারবাগ পুলিশলাইন্সে তাদের সরকারি বাসাতেই পারিবারিক পরিবেশে বিয়ের আয়োজন। কিন্তু অনেক পুলিশ কর্মকর্তাই ঐ বিয়েতে আসলেন, হাতে ওয়াকিটকি-কেমন যেন এক ধরনের মুগ্ধতা ভর করলো। কয়েকদিন ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম-পুলিশেই চাকরি করবো। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলাম অর্থাৎ পুলিশে যোগদান করলাম। তবে এর বাইরে সবাই যেটা বলে অর্থাৎ দেশের সেবা বা জনসেবা, সেটাও হয়তো কিছুটা ছিল, কিন্তু তা মূল কারণ নয়। কাজেই, আমার এক অনুজের ভাষায়, ‘I am a police officer by choice, not by chance.’  

পুলিশে যোগদানের পর প্রায় ২৫ বছর কেটে গেছে। পুলিশের ইতিহাস পড়তে এবং পড়াতে গিয়ে দেখেছি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক বর্তমান পুলিশের গোড়া পত্তনের পর প্রথমবার পুলিশ জনতার কাতারে দাঁড়ায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। যিনি যেভাবেই মূল্যায়ণ করুন না কেন, কোন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়াই একটা শৃঙ্খলা বাহিনীর সাধারণ সদস্যরা নিজেদের সিদ্ধান্তে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে- তাদের কত বড় বুকের পাটা তার মূল্যায়ন হয়তো সম্ভব হবে না। বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশকেই তখন তারা সরকারি আদেশ হিসেবে নিয়েছিলেন। বাস্তববাদী বলেই আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন যে, মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘসময় পুলিশের গৌরব করার মত তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে অনেক পুলিশ সদস্য নন্দিত হলেও সামষ্টিকভাবে পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই নিন্দিত ভূমিকা পালন করেছে। ইতোপূর্বে বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও সামগ্রিকভাবে পুলিশকে গণমুখী পেশাদার পুলিশ হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগের ঘাটতিই পরিলক্ষিত হয়। তবে বিগত দশকে পুলিশকে পেশাদার বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা বেশ কিছুটা এগোলেও শতবছরে গড়ে ওঠা ‘Subculture’ যেমন, মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, জনহয়রানি, দুর্নীতি, অদক্ষতা, স্বচ্ছতার অভাব, ব্যবহৃত হওয়ার অভ্যাস ইত্যাদি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। একটা বড় অংশের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন হলেও কোনো কোনো সদস্যের হঠাৎ অপকর্ম পুরো বাহিনীকেই জাতির সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাচ্ছি যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনমুখী পেশাদার পুলিশ বাহিনী গড়ার যে কার্যক্রম চালু হয়েছিল তা একটা অনবদ্য গতি পেয়েছে এই বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে দেশের এই মহাসংকটে। একাত্তরের পুলিশের কথা শুনেছি কিন্তু করোনাকালের পুলিশের সদস্য হিসেবে আমি দেখতে পারছি, এ এক অন্য রকম পুলিশ, জনতার পুলিশ। কি তার কাজ আর কি তার কাজ নয় সেটি বিবেচনা মূখ্য নয়, বরং যেখানে যখন যা প্রয়োজন দেখছে, পুলিশ তা-ই করছে। আইন-শৃংখলা রক্ষার পাশাপাশি, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, লকডাউন কিংবা ঘরে থাকা বাস্তবায়ন, সামাজিক দূরত্ব প্রতিপালন নিশ্চিতের প্রচেষ্টা, নিজস্ব অর্থায়ন এবং সমাজের দয়াবান মানুষদের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে ও গোপনে ত্রাণ পৌঁছানো, আটকেপড়া মানুষের ঘরে বাজার পৌঁছে দেয়া, রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে হাসপাতালে পাঠানো, অবিবেচক ভাড়াটিয়া কিংবা প্রতিবেশিদের কবল থেকে চিকিৎসাকর্মী ও করোনা রোগীকে পরিত্রাণ দেয়া, এমনকি করোনাতে মৃত্যু কিংবা করোনা সন্দেহে মৃতদেহের সৎকার- কোথায় নেই পুলিশ। পুলিশের সেই দূর্বীনিত, ঔদ্ধত্যপূর্ন চেহারার পরিবর্তে এক মানবিক অবয়বের পুলিশ। মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর যে সংস্কৃতি পুলিশের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু মনে হয় এরকম পুলিশই চেয়েছিলেন, দেশের সাধারণ মানুষও বোধহয় এমন পুলিশই দেখতে চায়। 

Advertisement

করোনা যুদ্ধে যারা সৈনিক তাদের আত্মোৎসর্গের মাধ্যমেই এই যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব, যেমনটি হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে। করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে এক নম্বর সেক্টর-হাসপাতালে লড়ছেন চিকিৎসাকর্মী, কিন্তু হাসপাতালের বাইরে অনেকগুলো সেক্টরে লড়ছে পুলিশ। দু’পক্ষকেই মূল্যও দিতে হয়েছে এবং হবে অনেক বেশি। ইতিমধ্যেই আমার চার সহকর্মী করোনা লড়াইয়ে শহীদ, তাদের আত্মদান আমাদের যেমন ব্যথিত ও মর্মাহত করে ঠিক তেমনি গৌরবে বুকের ছাতি ফুলিয়ে দেয়। আমার অনেক সহকর্মী ইতিমধ্যে এই লড়াইয়ে শামিল হয়ে আহত অর্থাৎ করোনা আক্রান্ত হয়েছে। সহকর্মীদের মৃত্যু ও আক্রান্তের খবরে আমরা থমকে যাই কিন্তু তা আমাদের দায়িত্বপালন থামাতে পারে না, পারবে না কখনোই। বড় ধরনের বাস্তব ঝুঁকি আছে জেনেও আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াই এবং দাঁড়াবো। 

চিকিৎসাকর্মী ও পুলিশ ছাড়াও করোনা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে লড়ছে প্রশাসন, সেনাবাহিনী, আনসার বাহিনীসহ নানা সরকারি বেসরকারি সংস্থা। পুলিশের মতই নানা সেক্টরে লড়ছেন সংবাদকর্মীরাও, আত্মদানের তালিকায় তারাও আছেন। আমি করোনা যুদ্ধে শহীদ সকলের আত্মার শান্তি কামনা করি, আরোগ্য কামনা করছি, যারা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন।

করোনাযুদ্ধে নাজেহাল ইংল্যান্ডের সরকারি কর্তৃপক্ষের ব্রিফিং এ তিনটি শব্দগুচ্ছ দেখি, “ Stay Home, Protect NHS, Save Lives”. অনুপ্রানিত হয়ে আমিও বলি, আপনারাই বাঁচাতে পারেন চিকিৎসাকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক কিংবা করোনাযুদ্ধে প্রথম সারিতে যুদ্ধরত সৈনিকদের। কেননা, আপনাদের বাঁচাতেই তারা হাসপাতালে ও বাইরে পরিশ্রম করে আক্রান্ত ও জীবন উৎসর্গ করছেন।

বৈশ্বিক ও জাতীয় তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে আমি বিশ্বাস করি যে করোনা মহাযুদ্ধে মানবজাতির জয়লাভের সময় ক্রমশঃ ঘনিয়ে আসছে। নজিরবিহীন দ্রুতগতিতে ভ্যাকসিনের পরীক্ষণমূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, অনেক দেশেই করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট ওষুধের পরীক্ষামূলক ব্যবহার চলছে। করোনা যুদ্ধে যারা টিকে থাকবে তারা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে “করোনা” নামক ঠান্ডা জ্বরে সমগ্র মানব জাতির নাকানি চুবানী খাওয়ার গল্প শোনাবে। কিন্তু যতদিন ভ্যাকসিন কিংবা ওষুধের সফলতার সুখবর না আসে ততদিন আপনারা দয়া করে-

 

### ঘরে থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন;

### প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পড়ুন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন;

### সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান;

### WHO এবং IEDCR প্রদত্ত পরামর্শ মেনে চলুন;

### সতর্ক থাকুন, নিজে বাঁচুন, পরিবার ও মানুষ বাঁচান। 

আপনি এগুলো মেনে চললেই আমাদের কাজটা কমবে, আমাদের ঝুঁকি কমে যাবে।

বিশ্বাস রাখুন, ‘আমরা করবো জয় একদিন!’

এআর/এএইচ