নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র হতে পারে যে প্রতিষেধক (ভ্যাকসিন), তা আসতে কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যান্থনি ফওসি। তবে কঠিন সত্যটা হচ্ছে, এ প্রতিষেধক সম্ভবত এত তাড়াতাড়ি আসছে না।
Advertisement
এখন পর্যন্ত যতগুলো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে বেশিরভাগই ব্যর্থ। নতুনটি তো বটেই, আজ পর্যন্ত করোনাভাইরাস পরিবারের কোনও সদস্যেরই মানবদেহে প্রয়োগযোগ্য প্রতিষেধক তৈরি হয়নি। অতীত রেকর্ডের হিসেবে, সাধারণত নতুন কোনও প্রতিষেধক তৈরিতে চার বছরের মতো সময় লাগে। এতদিন সামাজিক দূরত্বের বাধা সহ্য করার ক্ষমতা আসলে মানুষ বা অর্থনীতি কারোরই নেই।
তাহলে? এই সংকট কাটানোর কি কোনও উপায় নেই? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস। জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য এর চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-
করোনা সম্পর্কে জ্ঞানার্জনএমনিতে গবেষণার তহবিল সংগ্রহ, অনুমোদন, এর ফলাফলগুলো জমা করতে কয়েক বছর লেগে যায়। তবে বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। করোনার তাণ্ডব ঠেকাতে ইতোমধ্যেই অন্তত ৯৫টি সম্ভাব্য প্রতিষেধক ও ২৫৪টি থেরাপি নিয়ে কাজ চলছে।
Advertisement
বেলর কলেজ অব মেডিসিনের ন্যাশনাল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের ডিন ডা. পিটার হোটেজ বলেন, ‘এটাকে (প্রতিষেধক তৈরি) যদি ১৮ মাসের সময়কালের মধ্যে রাখতে চান তাহলে একটাই উপায়, প্রতিযোগিতায় যত বেশি সম্ভব ঘোড়া নামান।’
গত কয়েক মাসে করোনার প্রতিষেধক তৈরির জন্য অভূতপূর্ব উদ্যোগ দেখা গেলেও গবেষকরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, এর মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদন পেয়েছে। বাকিরা হয় কার্যকর প্রমাণিত হয়নি, নাহয় বর্তমান ওষুধের চেয়ে কম কার্যকর অথবা অনেক বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
তবে সৌভাগ্য বলতে হয়, সার্স ও মার্স সংক্রমণের কারণে ইতোমধ্যেই নতুন প্রতিষেধক তৈরির প্রাথমিক পর্বটি পার হওয়া রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সার্স ও সার্স-কোভ-২ (কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিকারী) ভাইরাস দু’টির মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মিল রয়েছে। দুটোই প্রোটিনে তৈরি কাঁটার মাধ্যমে মানবকোষ আঁকড়ে ধরে। এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই এত দ্রুত বিজ্ঞানীরা নভেল করোনাভাইরাসের পরীক্ষা শুরু করতে পেরেছেন। তবে দ্রুত কাজ করার জন্য মূল্যও চুকাতে হচ্ছে তাদের।
প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করা কোষ বিশেষজ্ঞ রবার্ট ভ্যান এক্সান বলেন, ‘পাইপলাইনে থাকা করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য প্রতিষেধকগুলো দ্রুত গবেষণার কারণ ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’ ২০২১ বা ২০২২ সালের আগে এই প্রতিষেধকের অনুমোদন হবে না বলেও মনে করেন তিনি।
Advertisement
তারপরও চেষ্টা থেমে নেই। ফরাসি বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি সানোফি সার্স গবেষণার প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত সম্ভাব্য কোভিড-১৯ প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে এ বছরের শেষভাগে। যদি সেটি সফল হয়, তবে ২০২১ সালের শেষের দিকে প্রতিষেধকটি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
প্রতিষেধক তৈরির স্থাপনাপ্রতিষেধকের অনুমোদন প্রাপ্তির পর আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে- গণহারে উৎপাদন। বিশ্বজুড়ে ইতোমধ্যেই হাম-পোলিওর মতো রোগের জন্য প্রতিষেধক তৈরি হচ্ছে। তবে সেসব জায়গায় করোনার প্রতিষেধক উৎপাদন সম্ভব নয়। নতুন প্রতিষেধকের জন্য সম্পূর্ণ নতুন স্থাপনা প্রয়োজন।
সাধারণত কঠোর নিয়মকানুন মেনে বায়োলজিক্যাল স্থাপনা প্রস্তুত করতে পাঁচ বছরের মতো সময় লাগে, যা প্রচলিত ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানা তৈরির চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি সময়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলাকালে প্রস্তুতকারকরা জরুরি ভিত্তিতে বর্তমান স্থাপনাগুলোকেই কোনোভাবে সাজিয়েগুছিয়ে এ প্রক্রিয়ার সময় কিছুটা কমাতে পারলেও এরপর থাকবে এফডিএ’র অনুমোদনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
প্রতিষেধক আসতে দেরি হলে?এইচআইভি নিয়ে গবেষণার প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেছে, এখনও এর পুরোপুরি কার্যকর কোনও প্রতিষেধক মেলেনি। গবেষণায় এ পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তা হলো- কিছু সংখ্যক তৃতীয় পর্যায়ের (ফেজ ৩) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এর মধ্যে আবার একটিতে রোগীর অবস্থা আরও ভয়াবহ করে তুলেছে, আরেকটিতে সফলতার হার মাত্র ৩০ শতাংশ।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের সাগে এইচআইভির প্রতিষেধক পাওয়ার আশা করছেন না তারা। ফলে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরিতে সময় লেগে যাচ্ছে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি।
তবে আশার কথা, এইচআইভির সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের খুব একটা মিল নেই। এটি খুব বেশি পরিবর্তিত (মিউটেট) হচ্ছে না, এর মতো প্রায় একই বৈশিষ্ট্যের আরও কয়েকটি ভাইরাসও আবিষ্কৃত হয়েছে।
এছাড়া, এইচআইভি থেকেই শিক্ষা নেয়া যায়, প্রতিষেধক আবিষ্কারে দেরি হলেও এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। গবেষকরা বেশ কয়েকটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আবিষ্কার করেছেন যাতে এইডসে মৃত্যুহার কমে গেছে এবং শরীরে রোগ নিয়েই মানুষজন বেঁচে থাকতে পারছেন।
এছাড়া, প্রতিষেধকের পরিবর্তে রোগ নিরামক ওষুধও করোনযুদ্ধে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত মার্চ থেকেই কোভিড-১৯ চিকিৎসার ওষুধের সন্ধানে নেমেছে। এই ওষুধ সফল হলে হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা কমে যাবে, রোগীরা দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন এবং ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমে যাবে।
ততদিন পর্যন্ত ব্যাপক হারে পরীক্ষার মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের শনাক্ত ও কোয়ারেন্টাইন রাখার কোনও বিকল্প নেই। অনেক দেশই এ প্রক্রিয়ায় সফল হয়েছে, ফলে সতর্কতা মেনে তারা লকডাউন তুলে দেয়ারও সাহস দেখাতে পারছে।
সুতরাং বলাই যায়, এসব চেষ্টা কার্যকর হলে আপনার হাতে সুঁই ফুটিয়ে প্রতিষেধক প্রয়োগের আগেই বিশ্বের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।
কেএএ/জেআইএম