রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সম্প্রতি তার এলাকায় স্থানীয়দের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছেন ‘দেশের রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। আর তা আমাদের দেশের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়। যেকোনো ভাবেই হোক এ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে।’ এ নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই, অনেকেই রাষ্ট্রপতিকে ধন্য ধন্য করছেন। রাষ্ট্রপতি ভুল কিছু বলেননি, নতুন কিছুও আসলে বলেননি। অনেকদিন আগেই এটা হয়েছে এবং তাদের মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের চোখের সামনে দিয়েই তা হয়েছে। শুধু তারা নীরবে দেখেছেন কিভাবে তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে রাজনীতি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এতে তাদেরও ভূমিকা আছে। বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ একবার কিছুটা স্যাটায়ার করে বলেছিলেন রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স ঢুকে গেছে। এর অর্থ হলো এখন দেশে শুধু রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন না। কিছু মুনাফালোভীর হাতেই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ। সেই মুনাফালোভীরা শুধু ব্যবসায়ী নন। ব্যবসায়ী হলে কিছুটা হলেও আশার জায়গা থাকতো, কারণ সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে কিছুটা হলেও পৌঁছে। এখন যাদের হাতে রাজনীতি, এরা এমন এক শ্রেণি যাদের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক অবস্থান দ্রুত অনৈতিক মুনাফা লাভের অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।এক আড্ডায় একজন প্রবীণ নেতা বললেন, আমাদের দল এখন চলে পার্টি বয়েজ এন্ড গার্লসদের কথায়, ভাবনায়, তাদের নেয়া কৌশলে, নির্দেশনায়। এরা কারা? উত্তরে তিনি বলেন, “আপনি সাংবাদিক, খোঁজ নিন, দেখবেন এরা কেউ আমলার সন্তান, কেউ ব্যবসায়ীর, কেউ দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীর, কাস্টমস ও পুলিশ কর্তার, কেউবা কোনো সময় ছিল কোনো ব্যবসায়ীর ভৃত্য। কেউ বড় সময়টাই কাটিয়েছে বিদেশে, মধু খেতে চলে এসেছে দেশে, আবার দল ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে এরাও উড়াল দেবে। এরা এখন ক্লাবে, হোটেলে পার্টি করে, সেখানে যোগ দেয় যারা তাদেরই যোগাযোগ সব বড় মানুষের সাথে, ক্ষমতাবানদের সাথে। তারা বড় বড় ব্যবসায়িক কাজের তদ্বির করে, এরা উচ্চ পর্যায়ের আমলা থেকে রাজনীতিক হওয়া ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ রাখে, এরাই বিভিন্ন ইস্যুতে দলের কর্মকৌশল ঠিক করে দেয়”। তাহলে, আপনারা কি করেন? এর উত্তরও আছে তার কাছে, বলেন, “আমরা পদ পদবী নিয়ে লড়াই করি, ভাগে আমরাও কিছু ব্যবসা বাণিজ্য পাই”। তার বিশ্লেষণে পিতৃ পরিচয় ছাড়া এদের সেই অর্থে আর কিছু ছিল না। রাস্তা থেকে উঠে এসে এরা এখন লাইসেন্স পারমিটের ঠিকাদারির সর্দার। তার মতে, এটা শুরু হয়েছে, স্বৈরাচার পতনের পর, গণতান্ত্রিক পথে দেশের যাত্রা শুরুর পর। স্বৈরাচার ব্যবসায়ী আর ধর্ম ব্যবসায়ীদের এনেছিল রাজনীতিতে, গণতন্ত্রের আমলে পার্টি বয়েজ এন্ড গার্লসরা জায়গা করে নিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার বদল হয়, পার্টি বয়েজ এন্ড গার্লসদের ভবন হয়, ভবন বদলে ক্লাব হাউজ থেকে, হোটেল কক্ষের পানের আসর থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতি আর প্রশাসন, তাদের প্রাচুর্যও বাড়ে। এখন সুদূর মফস্বল শহরেও প্রবীণ রাজনীতিকরা সন্মান হারানোর ভয়ে আর রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে যান না, সেখানেও আছে আরেক ধরনের “স্মার্ট ইয়ুথস”, যারা যখন তখন যাকে তাকে, যে কোনো বয়সের ব্যক্তিকে যে কোনো ধরনের অপমান হাতে ধরিয়ে দিতে পারে। দেশে গণতন্ত্র নেই বলে যারা চিৎকার করেন তারা ভাবতে কি পারেন দলে কোনো গণতন্ত্র আছে কিনা? সবগুলো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল চলে কোনো একক বা তার সহযোগী কিছু ব্যক্তির ভাবনায়। বিরোধী দলে থাকলে গণতন্ত্রের কথা রাজনীতিকরা বললেও ক্ষমতায় গিয়ে তারা তা ভুলে যান। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, রাজনৈতিক দল চলে গেছে ব্যবসায়িদের পকেটে। কিন্তু তার কথায় পরিষ্কার হয়নি, রাজনৈতিক অর্থায়ন হয় কিভাবে। দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র নেই, তাই রাজনৈতিক অর্থায়নের কোনো স্বচ্ছতাও নেই। রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন রাজনীতিবিদরাই। পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসন অরাজনীতিকদের ক্ষমতাশালী করেছে, আর স্বৈরাচার হটিয়ে জনগণ যাদের এনেছে, তারা পালাক্রমে রাজনীতিকে নিয়ে গেছে ভুঁইফোড় ব্যবসায়ী আর তথাকথিত পার্টি বয়েজ এন্ড গার্লসদের হাতে। তবে রাজনীতিকদের মধ্যে যারা কথায় কথায় সামরিক শাসকদের দোষারোপ করেন তারাও একটু ভেবে দেখতে পারেন এজন্য তাদের ভূমিকা কতটুকু। কিছু বনেদি রাজনীতিক সবসময়ই পাওয়া গেছে সামরিক আর অরাজনীতিক ব্যক্তিদের ক্ষমতায় সহায়তা করতে। এটা সামরিক শাসনামলে যেমন দেখা গেছে, দেখা গেছে সামরিক সহায়তাপুষ্ট অসামরিক শাসনামলেও। যাঁরা এখন রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে নেই বলে আক্ষেপ করছেন, তাঁদেরই দেখা গেছে সামরিক–বেসামরিক সাবেক আমলা ও ব্যবসায়ীদের দলে নিয়ে আসার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে।রাজনীতিতে বহিরাগত সমস্যা একটি বড় সমস্যা। কিন্তু এটি হয়েছে মূলত রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রচর্চা না হওয়া এবং নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতা আর অর্থের পেছনে ছুটে চলার কারণে। প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে গিয়ে এই রাজনীতিকরাই মাস্তান ও সন্ত্রাসীদের লালন করছেন। রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতেই ফিরুক। কিন্তু সেটি কীভাবে? প্রায় তিন দশক হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। রাজনীতিক তৈরি হবে কি করে? আর আছে, অতীতাশ্রয়ী রাজনীতির আবিষ্টতা ও আচ্ছন্নতা। শুধু নির্বাচনে জেতার যে রাজনীতি তা রাজনৈতিক প্রজন্ম তৈরি করে না। এইচআর/এমএস
Advertisement