এ এক অন্যরকম সময়, আতঙ্কপূর্ণ ক্ষণ। এমন সময় পৃথিবীতে স্মরণাতীতকালে আর লক্ষ্য করা যায়নি। যুদ্ধকালেও মানুষ এতটা আতঙ্কিত হয়নি। মানুষকে এতটা বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যেতে হবে, সেটা ভাবেনি কোনো মানুষই। অন্ধকারের সঙ্গে প্রতিনিয়িত লড়াই করা মানুষ নিজেকে ও প্রিয়জনকে নিয়ে চরম অসহায় দিনযাপন করছে। শুধু একটি ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে যেভাবে অনিশ্চিত লড়াই করছে বিশ্ববাসী তা চূড়ান্ত রকমের অস্বাভাবিক। তবুও জীবন চলছে জীবনের নিয়মে। কে কতক্ষণ সুস্থ থাকে বা কতক্ষণ জীবিত থাকে সে উৎকণ্ঠাও লক্ষণীয়।
Advertisement
এ রকম দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও নির্দেশ পালনের ক্রমাগত নিবেদন থেকে পিছপা হননি বিশ্বাসীরা। আর যাদের বিশ্বাস বা ভাবনায় ঘাটতি ছিল তারাও নিবেদিত হয়েছেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায় যথাযথভাবে পবিত্র রমজান পালন করছে। ধারাবাহিক পরিক্রমায় ঈদও আসবে। তবে রোজার ধর্মীয় যে আবহ করোনাভাইরাসের কারণে তার ব্যাঘাত ঘটেছে। ঈদের আনন্দও এবার ফিকে হবে সেটা নিশ্চিত। পারস্পরিক প্রীতি ও সৌহার্দের জায়গাটি সংকুচিত করে দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী অব্যাহতভাবে আক্রমণ করা করোনাভাইরাস।
এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যেন ছুঁতে পারেনি চোর ও লুটেরাদের। ভয়াবহ মহামারি করোনাভাইরাসের নগ্ন থাবার মধ্যেও ত্রাণ চুরির মচ্ছব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রয়েছে ত্রাণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ। বিভিন্ন শ্রেণির জনপ্রতিনিধি এবং নানা ধরনের প্রভাবশালীরা ত্রাণ চুরি বা লুট করছেন। এসব ঘটনার কমবেশি বিচারও আমরা লক্ষ্য করেছি। কেউ কেউ সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। ত্রাণ বা খাদ্য সহায়তার জন্য অনেকে ছুটে বেড়ালেও পাচ্ছেন না এমন অভিযোগও রয়েছে। এসব অপকর্ম নিয়ে তথ্যবহুল রিপোর্ট করার কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনাও আমরা দেখতে পাই।
বাংলাদেশে দুর্নীতি, অপকর্ম, ত্রাণ চুরি বা লুট একটি নিয়মিত ঘটনা। অপকর্ম করেও অধিকাংশ ব্যক্তি পার পেয়েছেন বা পুরস্কৃত হয়েছেন, এমন নজিরও ভুরি ভুরি। এক্ষেত্রে যারা অপকর্ম ঠেকানোর দায়িত্বে রয়েছেন তাদের গাফিলতিই মূল কারণ। এই গাফিলতি সমাজ ও রাষ্ট্রকে যথেষ্ট ক্ষতবিক্ষত করেছে। আর দেশের মানুষতো নিয়মিতই অপকর্মকারীদের হেনস্তার শিকার। যেমন এখনকার ভয়াবহ সংকটকালেও আমরা দেখছি দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি। রমজান সংযমের বারতা নিয়ে এলেও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে এ মাসটি বরাবরই অসৎ রোজগারের মাস হয়ে ওঠে। সংযমের পর আনন্দের বারতা নিয়ে ঈদ এলেও ওই ব্যবসায়ীদের কাছে তা বাণিজ্যিক ফায়দা লোটার মচ্ছবে পরিণত হয়। এরা সংযমের মাস ও পরবর্তী আনন্দ বারতাকে তাদের লোভের নগ্ন থাবায় পদপিষ্ট করেন।
Advertisement
কিন্তু এমনটিতো হওয়ার কথা নয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রেই শৃঙ্খলা থাকবে। তাহলে ব্যবসায়ী তথা লুটেরারা শৃঙ্খলার বাইরে থাকেন কী করে? এককথায় জবাব আসবে অর্থ ও প্রভাবের জোরে তারা পার পেয়ে যান। সেই জোর এই করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যে কতটা বহাল থাকবে বা এরপর কী হবে সেটি আজ রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্টদের ভাবার সময় এসেছে। এই সময়ে চাই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। ত্রাণ চুরি বা লুট করে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে যারা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না।
করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় মানুষ আজ দিশাহীন। সেই মানুষগুলোকে নিয়ে যারা লুটপাটের খেলায় মেতে উঠেছে তাদের কোনোভাবেই ক্ষমা করা যাবে না। ত্রাণলুটেরা, ত্রাণচোর, বাজার কারসাজিকারী, অযৌক্তিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকারীদের বিরুদ্ধে আশু ব্যবস্থা নেয়া কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিবর্গকে শুধু জরিমানা বা দু-চারদিন কারাদণ্ড দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
সে জন্য এ ধরনের ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিয়ে পাড়ায়-মহল্লায় দৃশ্যমান প্রচারণা চালানো দরকার। প্রয়োজনে এদের অপরাধের কথা উল্লেখ করে পোস্টার-লিফলেট-ব্যানার তৈরি করে প্রকাশ করতে হবে। এদের মধ্যে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তারা সে ঋণের টাকা উল্লিখিত খাতে সঠিকভাবে ব্যবহার করছেন কিনা তার তদন্ত হওয়া দরকার। ব্যবসায়ী নামধারী এ ধরনের লুটপাটকারীদের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে বয়কট করা প্রয়োজন।
উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান বাংলাদেশের প্রাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু করেছেন তার সুফল পেতে হলে এই লুটেরাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শুদ্ধ করতে হলে অসৎ রাজনীতিবিদ, অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ সমাজপতি ও লুটেরাদের নির্মূল করতে হবে। নতুবা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বা শুদ্ধ বাংলাদেশ শুধু কথার কথা হয়েই থাকবে।
Advertisement
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
এইচআর/বিএ/পিআর