জাতীয়

মানবকল্যাণে সর্বদা নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন তিনি

মানবকল্যাণে সর্বদা নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য প্রকৌশলী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। মৃত্যুর আগের দিনও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবাইকে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষায় নানা পরামর্শ দিয়ে গেছেন। এমনটি জানিয়েছেন মরহুমের সাবেক সমকর্মীরা।

Advertisement

বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ মরহুমের সৃতিচারণ করে বলেন, জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের সঙ্গে জীবনের দীর্ঘ সময় আমরা বুয়েটে কাজ করেছি। তার কাছে কোনো সমস্যা নিয়ে গেলে সহজভাবে তিনি তা সমাধান করে দিতেন। তার মতো এমন উজ্জ্বল নক্ষত্র ও মেধাবী একজন মানুষকে হারিয়ে আমরা শোকাহত।

এই শিক্ষক নেতা বলেন, স্যার সবসময় বুয়েটের কল্যাণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মৃত্যুর আগের দিন (সোমবার) পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের সবাইকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত ভিডিও কনফারেন্সে নানা ধরনের দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়েছেন। সবাইকে বাসায় থাকার পরামর্শ দিয়েছেন, অতি প্রয়োজনে কেউ বাসার বাইরে বের হলে মাস্ক পরে বের হওয়া, প্রয়োজনে পিপিই পরতে বলেছেন। কীভাবে সবার কাছে এসব প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেয়া যায় তা নিয়ে তিনি নানা পরামর্শ দিয়ে গেছেন।

এ কে এম মাসুদ আরও বলেন, জামিল স্যার সব সময় মানবকল্যাণে কাজ করেছেন। এত কাজ, এত দায়িত্ব কীভাবে পালন করেন— স্যারের কাছে জানতে চাইলে বলতেন, কাজের মধ্যে মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়, যেদিন মানুষের কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে যাবে সেদিনই মানুষের মৃত্যু ঘটবে। কাজের মধ্যে নিজেকে চিনতে হবে, তাই আমি নিজের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি।

Advertisement

মরহুমের স্মৃতিচারণ করে এই শিক্ষক আরও বলেন, জামিল স্যারের স্মৃতিশক্তি ছিল প্রচণ্ড ধারাল। বৃদ্ধ বয়সেও অনায়াসে তিনি সবকিছু মনে রাখতে পারতেন। সহজেই সবার সঙ্গে মিশে যেতেন। এত গুণী একজন মানুষের কিন্তু কোনো ধরনের অহঙ্কার ছিল না। কারও বিপদ হলে তিনি নিজেই পাশে এসে নিজের সমস্যা মনে করে তা সমাধান করে দিতেন। দেশে তার মতো আর একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন এ দেশের স্বনামধন্য একজন প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্বনামধন্য অধ্যাপক। এছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধু সেতু প্রকল্পের প্রধান পরামর্শকসহ জাতীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা বিস্তার ও প্রকৌশল গবেষণায় অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশ একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে হারাল, একজন বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদকে হারাল। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রযুক্তিগত দিকনির্দেশনা প্রদানে তিনি যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। বলা চলে, বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হারিয়েছে।

‘যখন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন তখন অত্যন্ত বিনয়ী হিসেবে তাকে দেখতে পেতাম। অন্যরা যেসব মতামত ব্যক্ত করতেন তিনি হয়তো দ্বিমত পোষণ করতেন কিন্তু সেটা বোঝা যেত না। তার যুক্তি খণ্ডন আমাদের খুবই অনুপ্রাণিত করত।’

Advertisement

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, এমন একজন শিক্ষকের প্রস্থান কখনও কাম্য নয়। বাংলাদেশে যে বিশ্বমানের প্রযুক্তির ছোঁয়া, তার প্রমাণও তিনি। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশে গণিতের ভয়, প্রযুক্তির ভয়গুলো কাটিয়ে উঠতে তিনি যথেষ্ট কাজ করেছেন। সত্যি বলতে তাকে হারিয়ে আমাদের যে ক্ষতি, সেটি অপূরণীয়।

কথা সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, অধ্যাপক জামিলুর রেজা স্যার সব সময় একটি রুটিনমাফিক নিয়মে চলতেন। তার হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া আমাদের মাঝে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এমন একজন দেশপ্রেমিক মানুষের অনেক দিন বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল। তার ভেতরে কোনো রাজনীতি ছিল না। যখন যে ডেকেছে, তার ডাকে সানন্দে সাড়া দিয়েছেন। গণিত অলিম্পিয়াড বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন কাজে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। পদ্মা সেতু, যমুনা সেতুর কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত ছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে এমন একটি মানুষের চলে যাওয়া অনেক বেদনার, অনেক কষ্টের।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যুতে দেশ একজন স্বনামধন্য, প্রথিতযশা ও আত্মনিবেদিত প্রকৌশলী হারাল। তিনি শিক্ষকতা ও দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে সমগ্র জাতি আজ শোকাহত। বাংলাদেশ এক অমূল্য সম্পদ হারাল।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ। তার মৃত্যতে আমরা অমূল্য সম্পদ হারালাম।

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরীর মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে তার অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।

জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী মঙ্গলবার ভোররাতে ইন্তেকাল করেন। তার আত্মীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম জানান, গত রাতে ধানমন্ডির বাসায় জামিলুর রেজা চৌধুরী ঘুমিয়ে ছিলেন। ভোরে সেহরির সময় তার স্ত্রী তাকে ডাক দেন। কোনো সাড়া না পাওয়ায় তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে আনার আগেই তিনি মারা যান।

জামিলুর রেজা চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। বাদ জোহর জানাজা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

জাতীয় এই অধ্যাপকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সব শ্রেণি ও পেশার বিশিষ্টজনেরা। বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ চলমান নানা উন্নয়ন প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।

এমএইচএম/এমএআর/এমএস