করোনা বদলে দিয়েছে এ বিশ্ব। মানবিক এক নতুন বিশ্ব দেখছে গোটা বিশ্বের মানুষ। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই মানবকিতায় জেগে উঠেছে মানবতা। পশ্চিমের অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের সুরক্ষা দিচ্ছে, এটা তাদের রাষ্ট্রীয় দায় থেকেই করা হয়, সবসময়ই। কিন্তু এই দেশগুলোতেও কথা উঠেছে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে, স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতা নিয়েও।
Advertisement
কিন্তু তারপরও আটকে থাকছে না কোনোকিছুই। ইতোমধ্যে সারা পৃথিবীই জেনেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই নায়কের কথা, যিনি ব্রিটেনে তার জন্মদিন পালন করবেন ৩০ এপ্রিল। ১০০তম জন্মদিনকে সামনে রেখে ক্যাপ্টেন টম মুর তার বাসস্থানের পেছনের গার্ডেনে ১০ দিনে তার হুইল চেয়ার দিয়েই ১০ বার ঘুরবেন এই প্রত্যয়ের কথা জানিয়ে তিনি একটা ফান্ড রেইজের কথা প্রচার করেছিলেন। বলেছিলেন মাত্র এক হাজার পাউন্ড তিনি সংগ্রহ করে এগুলো দিয়ে দেবেন তাদের, যারা প্রাণান্ত পরিশ্রমে ব্রিটেনকে বাঁচাতে চাচ্ছে। ব্রিটেনের সবচেয়ে আলোচিত এই সেক্টর হলো এখন তাদের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস)। এই স্বাস্থ্যসেবা ব্রিটেনে গর্বের একটা জায়গা। আবার এই সেক্টরই অর্থনৈতিক সংকটে ছিল বিধ্বস্ত। রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত জায়গা ছিল এটি। এই জায়গাটা এক নতুন চিত্র পেয়েছে পৃথিবীর বর্তমান মহাদুর্যোগে। এই দুর্যোগকালীন এরাই হয়ে উঠেছে ব্রিটেনের সবচেয়ে নির্ভরতার স্থান।
এই জায়গাটাতেই মুর মাত্র এক হাজার পাউন্ড দিতে চেয়েছিলেন। এক হাজার পাউন্ড ব্রিটেনের এনএইচএসের জন্য সাগরের মাঝে মাত্র এক ফোটা বৃষ্টির মতো। কিন্তু তারপরও তিনি হয়তো চাইছিলেন শুরু হোক একটা কিছুর। কিন্তু বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছে গোটা দেশ, হয়তো গোটা পৃথিবী। এখনও দুইদিন সময় আছে অথচ অনুদান সংগৃহীত হয়েছে ২৯ মিলিয়ন পাউন্ডেরও অধিক, প্রায় তিনশ কোটি টাকার মতো।
এই করোনা প্যানডেমিকেই ইতোমধ্যে ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবা ঢেলে সাজানো হয়েছে। এনএইচএসের দেনা ছিল ১৩.৪ বিলিয়ন পাউন্ড। অর্থনীতির চরম বিপর্যয়েও সরকার এর দায়িত্ব নিয়েছে ঋণমুক্ত হয়েছে এ খাত। এনএইচএস ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। শুধু মুরের ২৯ মিলিয়ন পাউন্ড নয়, এনএইচএসকর্মীদের বাড়তি পুরস্কারের জন্য সরকার নয়, বাইর থেকে অনুদান আসছে তা-ও মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড। ডিউক অব ওয়েস্ট মিনিস্টার ১২ মিলিয়ন পাউন্ড অনুদান দিয়েছেন এর মাঝে বড় অংশ যাচ্ছে এনএইচএসকর্মীদের জন্য এবং কেয়ার হোমের বয়স্কদের সেবা বৃদ্ধিতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হতে।
Advertisement
সরকার থেকে ঘোষণা এসেছে, মুনাফা কিংবা অর্থ বাঁচানোর জন্য চিকিৎসার ইকুইপমেন্টের জন্য আর বাইরের দেশের ওপর নির্ভরতা নয়, ভর্তুকি দিয়ে হলেও দেশেই এই জাতীয় ইন্ডাস্ট্রিকে সচল করে তোলা হবে। শুধু তাই না, বাইরের দেশের দিকে তাকিয়ে থাকা নয়, অনেক ওষুধ কোম্পানি অর্থাৎ বিজ্ঞানীদের জন্য এই ব্রিটেনেই বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হবে এখন, করোনা পরবর্তী ব্রিটেনে, ইউরোপ-আমেরিকায় আবার চিকিৎসা সরঞ্জাম আর জরুরি ওষুধ তৈরির কারখানা আবার শুরু হবে বেশ বড় মাত্রায়।
গত ১৭ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করেছে, ব্রিটেনের ভ্যাকসিন তৈরির বন্ধ করে দেয়া শহরের ল্যাবগুলো আবার চালু হবে। প্রস্তুত হবে ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন। বরাদ্দ থাকবে হাজার কোটি টাকা। মহাদুর্যোগে যাতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়, সে জন্য এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। একদিকে এই দুর্যোগে চাকরি হারাবে অসংখ্য মানুষ, আবার একইভাবে এইসব খাতে হাজার হাজার কর্মসংস্থান হবে। শুধু কম্পিউটার সায়েন্সই নয়, রসায়ন, পদার্থ প্রভৃতি অধ্যয়নে তরুণ-তরুণীরা আরও উদ্বুদ্ধ হবে।
পৃথিবী এখন একটা গ্রাম। এই গ্রামে কোনো নির্দিষ্ট জাতি ধর্ম-বর্ণের মানুষ বাস করে না। এই গ্রামে বাস করে একটা মাত্র জাতি, সভ্যতাকে বাঁচাতে হলে গোটা মানবজাতিকেই সুরক্ষা দিতে হবে। গ্রামের এক প্রান্তে আগুন ধরলে মসজিদ-মন্দির সবই জ্বালিযে দেয় এ আগুন। কাউকে ক্ষমা করে না। করোনা প্যানডেমিকতো তা-ই দেখিয়ে দিল। করোনা শিখিয়েছে, মুনাফা কিংবা ক্ষমতা, সন্ত্রাস কিংবা মারণাস্ত্রের উন্মাদনা দিয়ে সারা পৃথিবীকে তো নয়ই, এমনকি নিজস্ব রাষ্ট্রকেও নিরাপদ রাখা যায় না। বরং এই সব কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুই লাখ ছাড়িয়েছে মৃত্যু। এ মৃত্যু সহসাই কি থামছে? এক দেশ হ্রাস পাচ্ছে হয়তো, কিন্তু অন্য দেশ জ্বলে উঠছে, অদৃশ্য অনলে।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে খ্যাত দেশটি যেন কফিনের দেশ হয়ে গেছে। খেই হারিয়ে ফেলছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। যে মানুষটা পৃথিবীকে বশীভূত রাখতে মারণাস্ত্রের প্রতি সবচেয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন, সেই মানুষটা টয়লেট পরিষ্কারের ডিসইনফেকটেড (জীবাণুনাশক) ইনজেকশন মানবদেহে ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে নিজেই হয়ে উঠেছেন বিনোদনের এক বিশ্বনেতা। সাংবাদিকদের সাথে 'ন্যাস্টি' আচরণ করেছেন, কেন্দ্র আর স্থানীয় সরকারের সাথে দ্বন্দ্বে মেতে উঠেছেন তিনি। মনে হচ্ছে, ব্যক্তিগত বাণিজ্যই যেন তার ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে, তাই মানুষের জীবন বাঁচানো কিংবা নিরাপত্তার চিন্তা না করেই মৃত্যুপুরী নিউইয়র্ক শহর পর্যন্ত খুলে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টাটাই করেছেন।
Advertisement
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংকটের মতোই বাংলাদেশও মহাদুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে আছে। ১৬ কোটি মানুষের দেশ। এ দেশটা বিস্ময়করভাবে মোকাবিলা করছে এ দুর্যোাগ। ভাবতেই অকল্পনীয় মনে হয়, কীভাবে এই দেশটা এ সংগ্রামে জয়ী হবে। জয়ীতো হতেই হবে। মানুষের মৃত্যুতো আটকাতে পারছে না পশ্চিমাবিশ্বও। লাখ লাখ মৃত্যু, তবুও তো সভ্যতা বিলীন হয়ে যাবে না। এই সভ্যতারই অংশ বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি কিংবা পারিপার্শ্বিকতা। সভ্যতার ক্রমবিকাশে এ মৃত্যুর সাথে সাথেই আমাদের আগাতে হবে। মৃত্যুকে সাথে নিয়েই সরকারের অর্থনৈতিক পদক্ষেপকে আমার মনে হয়েছে এমনকি পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের সাথে টেক্কা দিতে পেরেছে।
৯৫ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্রণোদনা কম কথা নয়। এই অর্থ দিয়ে লকডাউনে দেশের মানুষ অভুক্ত থাকার কথা নয়। কৃষকদের গোলায় ধান উঠতে কিংবা দুগ্ধজাত খামার যেন নিষ্প্রাণ পড়ে না থাকে তার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা যাতে বেতন পায়, অভুক্ত না থাকে সে জন্য মালিকদের কাছে দুই হাজার কোটি টাকা গেছে। তবুও গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেতনের জন্য রাস্তা অবরোধ করছে। হাজার হাজার টন চাল জেলা-উপজেলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তবুও চাল-তেল চোর ধরা পড়েছে। এবং এরা কোনো না কোনোভাবেই সরকারদলীয়। এখন সারা দেশটাই আওয়ামী লীগের। সার্থকতা যদি আসে তাতো স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগেরই। আর চালচুর বলি আর যেকোনো দুর্নীতির সাথে যুক্ত থাকা মানুষই বলি এ সময়ে এই দায়টা আওয়ামী লীগেরই ওপর বর্তায়। আবার এ সময়ে পুলিশ-র্যাব আর প্রশাসনের কিছু চৌকস মানুষের কর্মতৎপরতা এতটাই মানবিক হয়েছে যে, মনে হয়েছে বদলে গেছে বাংলাদেশ।
কিন্তু তারপরও কেন জানি সমাজের অর্থনৈতিকভাবে উপরতলার মানুষগুলোর অধিকাংশই মানবিক হওয়ার মতো কোনো উদাহরণ রাখতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীও এদের 'খাই খাই' নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত না করে ভিআইপি হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা নাগরিকদের প্রতি উপহাসের সমান এবং প্রকারান্তরে তা ওই উপরতলার মানুষগুলোকেই আরও উগ্র হতে উদ্বুদ্ধ করবে বরং এখন স্বাস্থ্যসেবা আরও গণমুখী করার উদ্যোগই প্রয়োজন। 'গণস্বাস্থ্য' নিয়ে সরকার অন্তত একটা বিবৃতি দিয়েছে। দেরিতে হলেও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমানের বিবৃতিতে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব ফুটে উঠেছে। এ মহাদুর্যোগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আবিষ্কৃত কিট অনুমোদনে সরকারের জরুরি পদক্ষেপ নেয়াই ভালো। এতে সরকারের কোনো ক্ষতি নেই। বরং যেকোনো ধরনের অপপ্রচার থেকে মুক্ত থাকবে দেশ। অন্যদিকে এ সময়ে মানুষের মাঝে একটা স্বস্তিও আসতে পারে, স্বল্পমূল্যে এ কিট পেয়ে।
বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী আমরা হতেই পারি। গত শুক্রবার ব্রিটেনভিত্তিক একটি অনলাইন পত্রিকার এক অনলাইন আলোচনায় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাককে বর্তমান কিছু অসঙ্গতির কথা তুলে ধরলে, অকপট তিনি তা স্বীকার করেন। তবে এও বলেন, সরকার এ ব্যাপারে দৃঢ় পদেক্ষেপ নিচ্ছে, এমনকি যেদিন আমরা আলোচনা করছিলাম সেদিনও চারজন জনপ্রতিনিধিতে তারা বরখাস্ত করেছেন বলে জানান। আলোচানায় উপস্থিত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের কথার রেশ ধরে মন্ত্রী বলেন, সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটা দল হিসেবে এ সময়েও দেশের মানুষের জন্যই কাজ করে যাচ্ছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের রাস্তায় নামার কথা যখন জানতে চেয়েছিলাম, সেই একই কথা বললেন, সরকার সেই অসাধু লুটেরা ধনিকদের ব্যাপারেও আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এ সময় অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, তার পার্টি সিপিবিরি নেতৃত্বে গার্মেন্টস শ্রমিকদের এই আন্দোলন হয়েছে।দেড় ঘণ্টার এ আলোচনায় মন্ত্রী বলেন, কৃষকদের গোলায় বোরো ধান তুলতে বর্তমান সরকার গুরুত্ব দিয়েছে, এবং তিনি এও বলেন যে, ইতোমধ্যে ৪০ শতাংশ ধান মানুষ তুলতে পেরেছে। বাংলাদেশে এখনও এক বছরের রিজার্ভ আছে, এবং এ ধান উঠে গেলে দুর্যোগ মোকাবিলা করার পরও রিজার্ভে কোনো ব্যাঘাত ঘঠবে না, এমনকি একটা উন্নয়নশীল দেশ হলেও আগামীর অর্থনীতিতে বিরূপ কোনো প্রভাব পড়বে না বলেই তারা আশাবাদী।
করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দক্ষ পদক্ষেপ নেয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করা হয়েছে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসে। সম্প্রতি নারী নেতৃত্বাধীন আটটি দেশের করোনা মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে লেখা এ নিবন্ধে শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কানাডিয়ান লেখক অভিভাহ ভিটেনবার্গ-কক্স।
দেশের একটা উপজেলায় আমি আমার মাকে যখন ফোন করি কিংবা খোঁজ নেই প্রতিদিন কোথাও না কোথাও, তখন কেন জানি এক অদৃশ্য আতঙ্ক দেখি তাদের মাঝে। পাশের গ্রামে করোনা পজিটিভ এসেছে; বাংলাদেশের প্রতিদিনের মৃত্যু আমার আশি বছর বয়সী মায়ের জন্য শঙ্কা জাগায়, যেমন এখানেও আমরা শঙ্কিত থাকি। টেলিফোনের ওপর প্রান্ত থেকে শুনি মায়ের চাপাকান্না 'তোমরা ভালোতো, আমরা ভালো আছি'।
ব্রিটেন যেখানে আগামী মাসে প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষের টেস্ট করতে পারবে, সে জায়গায় বাংলাদেশের প্রতিদিন তিন- চার হাজার পরীক্ষা হচ্ছে, এটাও কম না। সে জন্যই আশাবাদী হই, আর কায়মনোবাক্যে কামনা করি, ফোর্বসে যে তথ্য দিয়েছে এটাই সত্যি হোক, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনা জয়ে যেন সফলই হয় বাংলাদেশ।
এইচআর/বিএ/জেআইএম