মো. আবুল কালাম আজাদ
Advertisement
বিশ্বব্যাপী করোনাযুদ্ধে সামনের কাতারের সেনানী হচ্ছে ডাক্তার, নার্স এবং চিকিৎসা ও করোনা টেস্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বাস্থ্য বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সন্দেহজনক ব্যক্তির করোনা পরীক্ষা, হোম কোয়ারেন্টাইন বা ঘরবন্দি করা, আলাদা করে রাখা বা আইসোলেশন, শনাক্তকৃত রোগীর ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা সকলই স্বাস্থ্য বিভাগীয় কাজ। এর জন্য প্রয়োজন চিকিৎসক, নার্স, সরঞ্জাম, হাসপাতাল ইত্যাদি। আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর কোনো দেশ করোনার মতো মহামারির জন্য প্রস্তুত থাকে না।
কিন্তু নিজ সামর্থ্যের মধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া এবং পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে যদি আমরা খেয়াল করি, দেখব প্রথমে আমাদের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে করোনা শনাক্তের প্রাথমিক কাজ শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে তা সম্প্রসারিত হয়ে ২২টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। জেলা পর্যায়ে এটি সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
অনেকে বলেন, প্রস্তুতির জন্য আমরা যে সময় পেয়েছি, তাতে ইতোমধ্যে জেলা পর্যায়ে পরীক্ষার সক্ষমতা অর্জন করা উচিত ছিল। এটি বোধ হয় আমাদের মনে রাখা দরকার, স্বাস্থ্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে দায়িত্ববোধ কারও চেয়ে কম থাকার কোনো কারণ নেই। নানা প্রকার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সমুদয় সক্ষমতা দিয়েই তারা কাজ করছেন। আমরা সম্প্রতি সিলেটের চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দিনের দেশপ্রেম, মানবতাবোধ এবং কাজের প্রতি একাগ্রতা দেখেছি।
Advertisement
আমরা মিডিয়াতে দেখেছি অনেক চিকিৎসক নিজ দায়িত্বের বাইরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন- অনেকের নাম বলা যায়, স্থানাভাবে নাম দেয়া থেকে বিরত রইলাম। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি অধিকাংশ স্বাস্থ্যকর্মীই ডা. মঈনের মত নিজ দায়িত্বের প্রতি প্রচণ্ড নিষ্ঠাবান এবং আন্তরিক। এর বিপরীতে দু-চারটি ব্যত্যয় থাকতে পারে কিন্ত সে বিষয়কেই অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবা এবং সব চিকিৎসক, নার্সকে সরল সমীকরণে কর্তব্যবিমুখ বলে চিহ্নিত করার কারণ নেই।
করোনার সহযোদ্ধা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের ধরন ও ব্যাপ্তি পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হয়েছে ও বেড়েছে। কাজের তালিকা যদি দিতে হয়, প্রাথমিকভাবে করোনা সন্দেহভাজনকে ঘরবন্দি রাখা, লাল পতাকা উত্তোলন, ঘরবন্দিকে মনিটর করা, শনাক্তকৃত রোগীকে খুঁজে বের করা, সাধারণ মানুষকে অধিক দ্রব্য কেনা থেকে নিবৃত্ত রাখা, বাজারমূল্য ঠিক রাখা, বাজারসহ পথ-ঘাটে একজন থেকে আরেকজনের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা, উন্মুক্ত স্থানে বাজার স্থানান্তর, লকডাউন এলাকা থেকে লোকজন বের হতে না দেওয়া এবং প্রবেশ না করতে দেওয়া।
গ্রামমুখী মানুষের স্রোত ও উল্টো স্রোত মোকাবিলা করা, করোনা হাসপাতাল এবং কোয়ারেন্টাইন এলাকা স্থাপনে স্থানীয় বাধা মোকাবিলা, করোনায় মৃত ব্যক্তির সৎকার করা, কর্মহীন ব্যক্তিদের ঘরে ঘরে সরকারি খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া, কতিপয় আত্মসাৎকারীকে আইনের আওতায় আনা- এমন আরও অনেক। সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে লকডাউন এলাকায় অপ্রয়োজনে বের হওয়া লোকদের ঘরে রাখার ব্যবস্থা করা।
প্রয়োজন ছাড়াও বিপুল সংখ্যক লোক চা খাওয়া, আড্ডা দেওয়া, ঘরে ভালো লাগে না ইত্যাদি বাহানায় ঘর থেকে বের হচ্ছে। এই ব্যতিক্রমধর্মী কাজগুলোর জন্য নিরলস পরিশ্রম করছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী ও আরও অনেকে। প্রধানমন্ত্রীর নিরলস পরিশ্রম, প্রজ্ঞা ও দিকনির্দেশনা তাদের সাহস ও মনোবল বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে।
Advertisement
পুলিশ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও নিজ কাজের বাইরে করোনা মোকাবিলায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিজেদের বেতনের টাকার একাংশ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেওয়া, করোনা আক্রান্ত হওয়ার প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা, ব্যস্ততম পেশা থেকে বেকার হয়ে যাওয়া মানুষের ঘরে নিজস্ব তহবিল থেকে খাবার পৌঁছে দেওয়া, চিকিৎসকদের যানবাহন সুবিধা প্রদান, করোনা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য লিফলেট বিতরণ, হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, মোবাইল শপ চালু করা, রাতের আঁধারে ত্রাণ নিয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে সেনাবাহিনী, গরিবদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করল বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী চীন থেকে নিজস্ব তহবিলে আনল করোনাসামগ্রী, বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে খুলনার ডাক্তার মাসুদকে ঢাকায় প্রেরণ ইত্যাদি কাজ তারা নিষ্ঠার সঙ্গে করছেন।
করোনাযুদ্ধের সময় আমাদের যা আছে- হাসপাতাল, পরীক্ষার সুবিধা, ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, ভেন্টিলেটর, পিপিই ইত্যাদি এগুলোই আমাদের শক্তি। ভেন্টিলেটর, পিপিই, করোনা চিকিৎসার হাসপাতাল ইত্যাদি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু আমরা কী বাড়াতে পারব ডাক্তার-নার্স? প্রাইভেট সেক্টরের ডাক্তার-নার্সরা যোগ দিতে পারেন। অনেক ডাক্তার স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে এসেছেন। অবসরপ্রাপ্ত নার্সদের কাজে লাগানোর বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।
এই নিয়েই আমাদের শক্তি। আবার প্রতিনিয়ত বেশ কিছু ডাক্তার-নার্স নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে কোয়ারেন্টাইনে চলে যাচ্ছেন। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর অনেক দেশেই ২০-৪০ ভাগ ডাক্তার-নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেছেন। পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি এসেছে অনেক নতুন কাজ। সবাই ছুটিতে থাকলেও স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমের বিপুলসংখ্যক কর্মী করোনাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে কাজ করে যাচ্ছেন। বেশ কয়েকটি চ্যানেলের অনেককর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। যখন সবাইকে বাধ্যতামূলক ঘরে থাকতে বলা হয়েছে তখন স্বাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলাকর্মী, মিডিয়া, পরিচ্ছন্নকর্মী ও কিছু জরুরি বিভাগ করোনার বিপদ মাথায় নিয়ে আমাদের নিরাপদ রাখার কাজ করছেন।
আমরা সবাই বলছি, এটা একটা যুদ্ধ। আর যুদ্ধক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব যারা পালন করছেন, তাদের সহযোগিতা করা সবার কর্তব্য। ওপরে যে বিভাগগুলোর নাম করা হয়েছে তাদের সবার কাজ সকল সময় প্রশংসারযোগ্য নাও হতে পারে। তবে বিচ্ছিন্ন কোনো কাজকে সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করার সরল সমীকরণ করার সময় এটা নয়। আমরা দুষ্টের দমন করব তবে মূল কাজ হচ্ছে করোনাযুদ্ধ।
চিকিৎসক-নার্সরা অন্যদের মতো করোনাভয়ে ভীত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা করোনাভয়কে জয় করে যেভাবে কাজ করছেন, কাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন তাদের জানাই সালাম। ডা. মিলনের রক্তের শপথ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এটাই সময়। এই যুদ্ধে সামিল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, সশস্ত্রবাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবক, মিডিয়াকর্মী সবাইকে জানাই সালাম। সালাম জানাই তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতাকে।
‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’- এটা সেই সময় ৭১-এর মতো আর একবার জেগে উঠবার। যোদ্ধা এবং সহযোদ্ধাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। জনগণও দায়িত্বশীল হবেন বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে না গিয়ে।
সভাপতি, বাংলাদেশ স্কাউটস এবং প্রাক্তন মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) ও প্রাক্তন মুখ্য সচিব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
এমআরএম