১৯৮৪ সালে শফিকুল ইসলাম মানিক যখন ব্রাদার্স ইউনিয়নে, তখন মোহামেডানে খেলেন আশীষ ভদ্র। ক্লাবজার্সিতে আলাদা হলেও জাতীয় দলে এক সাথে খেলেন বলে তাদের সখ্যতা ছিল অনেক। সেই সখ্যতার কারণেই একদিন আশীষ ভদ্রের খেপ খেলার এক অনুরোধে কিছু না জেনেই রাজী হয়ে গিয়েছিলেন মানিক।
Advertisement
ব্রাদার্সের আরেক তারকা ফুটবলার খন্দকার ওয়াসিম ইকবালসহ মানিককে নিশ্চিত করার দায়িত্বটা নিয়েছিলেন আশীষ। খেপ ওই সময় কম খেললেও আশীষ ভদ্রের অনুরোধ ফেলতে পারেননি মানিক আর ওয়াসিম।
কিন্তু খেলা কোথায়, কি টুর্নামেন্ট, ঢাকা থেকে কতদূর এবং কোন দলের হয়ে খেলবে এসব কিছুই জানতে চাননি মানিক আর ওয়াসিম। সেই ম্যাচ খেলতে জীবনের সবচেয়ে লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছিল মানিকের।
এক ম্যাচের জন্য পাক্কা আড়াই দিনের অ্যাডভেঞ্চার। বিমান, বাস, ট্রেনসহ সব ধরনের যানবাহনেই চড়া হয়েছিল কক্সবাজারের মহেশখালীতে এক ম্যাচ খেলতে গিয়ে। দীর্ঘ তিন যুগ আগের সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে নিজের কাছেই যেন অবিশ্বাস্য লেগেছিল সেই ভ্রমণকাহিনীর কথা। তো শফিকুল ইসলাম মানিকের কাছেই শুনে নেই আড়াই দিনের সেই অ্যাডভেঞ্চারের কথা।
Advertisement
‘আশীষ ভদ্র বললো আমরা তিনজন একটি দলে খেলবো। খেলা কক্সবাজার থেকে একটু সামনে। আমরা এর বেশি কিছু জানতে চাইনি। বিকেলে ম্যাচ। সকালের ফ্লাইট ধরে ঢাকা থেকে রওয়ানা দিলাম। চট্টগ্রাম থেকে বাসে চকোরিয়া। এরপর তিন চাকার কি যেন একটা যানবাহন, নাম মনে নেই। সেটাতে চড়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে অনেকদূর। এরপর সামনে একটা নদী। উঠলাম লঞ্চে। বিকেলের দিকে গিয়ে পৌঁছলাম। একটি স্কুলের মাঠ। তখনই দেখা গেলো মাঠের চারিদিকে হাজার হাজার মানুষ।
খেললাম। আমাদের দল জিতে চ্যাম্পিয়ন হলো। আমাদের যারা নিয়ে গিয়েছিলেন তারা অনেক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন বোঝা গেলো। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে আমরা ঢাকায় ফেরার জন্য রওয়ানা দিলাম। তো রাতের বেলায় তো আর ওভাবে ভেঙ্গেভেঙ্গে আসা সম্ভব নয়। তাই ওরা আমাদের কে লাইফবোর্ডের ব্যবস্থা করলো- সমুদ্র দিয়ে কক্সবাজার পৌছে দেয়ার। একটি ট্রলারে সমুদ্রে গিয়ে লাইফবোর্ডে উঠলাম। রাতে পাক্কা তিন ঘণ্টা সমুদ্রে। প্রচন্ড ভয় লাগছিল। তখন মনে হচ্ছিল না যেনে, না শুনে কেন এতদূর খেলতে এসেছিলাম! রাত ১০ টার পর কক্সবাজার পৌঁছলাম। একটি হোটেলে রাত কাটিয়ে ভোরে বাসে রওয়ানা দিলাম চট্টগ্রাম। সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম থেকে ধরলাম ঢাকার ট্রেন।
তো জীবনে এমন ভ্রমণ আর করিনি। প্লেন, বাস, ট্রেন, স্পিডবোর্ড, ট্রলার, লাইফবোর্ড, তিন চাকার যান। মাঝে একবার রিক্সায়ও চড়া হয়েছিল সামান্য একটু জায়গা যেতে। ধানক্ষেতের আইল দিয়েও হাঁটতে হয়েছিল। তবে সবচেয়ে ভয়েভয়ে ছিলাম সমুদ্রের ওই তিন ঘন্টা। ভয়ে বুক কাঁপছিল, নানা কথা মনে আসছিল। আসলে আমরা খেপ কম খেলতাম; কিন্তু মাঝেমাঝে এমন কেউ অনুরোধ করতো যে তা আর ফেলা সম্ভব হতো না। যেমন আশীষের অনুরোধ আমরা ফেলতে পারিনি। তবে সমুদ্রের মধ্যে আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, কোথায় খেপ খেলতে যাওয়া লাগলে সবকিছু যেনেশুনেই যাবো এরপর।’
জিততে না পারায় ঈদ কাটলো ক্লাবেই
Advertisement
‘১৯৮৬ সালে আমি মোহামেডানে। ওইবার লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম; কিন্তু পরপর দুই ম্যাচ ড্র করায় লজ্জায় ঈদের দিন আর ঘরে ফেরা হয়নি আমিসহ চারজনের। অন্য তিনজন হলেন মহসিন, আবুল ও রনজিৎ। ওই সময় কোচ ছিলেন আলী ইমাম ভাই। মোহামেডানের জন্য ওই বছর ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জের। আমরা জানতাম চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলে সমর্থকরা ক্লাবঘরের চালের টিন রাখবে না। টানা ১২ ম্যাচ জিতলাম। কিন্তু ১৩তম ম্যাচে ড্র পিডব্লিউডির বিপক্ষে। ব্যাস, শুরু হলো সমর্থকদের চোখ রাঙানি। কোচ ওই ম্যাচে একাদশের ৩-৪ জনকে ড্রপ করেছিলেন। ক্লাব কর্মকর্তা মনিরুল হক চৌধুরী তো ক্ষেপে আগুন। প্রস্তুতি নিতে থাকলাম পরের ম্যাচের জন্য। ঈদের আগের সন্ধ্যায় খেলা ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে।
চাঁদরাতের ওই ম্যাচও জিততে পারলাম না। গোলশূন্য ড্র। ক্লাবে ফেরার পর সবার মন খারাপ। পরিকল্পনা ছিল ম্যাচ খেলে রাতেই বাসায় ফিরে যাবো। আবুল, মহসিন, রঞ্জিৎ- আমাদের সবার বাসাই ঢাকায়; কিন্তু লজ্জায় আর ঘরে ফেরা হলো না। পরপর দুই ম্যাচ ড্র- মানুষ প্রশ্ন করলে কি জবাব দেবো? এখনতো খেলোয়াড়দের ম্যাচ হারার পরও কোনো হেলদোল থাকে না; কিন্তু আমরা ওই রাতে আর বাসায় যাইনি ড্র করায়। পরের দিন একটা খাশির ব্যবস্থা করে ক্লাবেই আমরা ঈদ করি। ঈদের দিন রাতে কিছু সময়ের জন্য বাসায় গিয়ে আবার চলে আসি।’
তোদেরটা খেয়ে তোদেরই গোল দেবো
‘ঈদের তিনদিন পর ম্যাচ ছিল আবাহনীর বিরুদ্ধে। পরপর দুই ম্যাচে চার পয়েন্ট হারিয়ে আবাহনীর বিরুদ্ধে আমাদের মাস্টউইন অবস্থা। আমরা জিতলে চ্যাম্পিয়ন, আবাহনী ড্র করলে। ওই সময় আবার এশিয়ান গেমসের জন্য জাতীয় দলের ক্যাম্প চলছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে। আমি দুপুরে ক্লাবে (পাশেই ছিল মোহামেডান ক্লাব) স্পেশাল কিছু রান্না হলে এক্সট্রা খাওয়া আনতাম। তো একদিন ক্যাম্পে ফিরতে একুট দেরি হয়েছিল। আমি ঢুকেই দেখি আমাকে ক্লাবের যে ছেলেটা খাবার এনে দিতো তাকে কি যেন বলছেন আসলাম ও আশীষ ভদ্র। দুইজনই তখন খেলেন আবাহনীতে।
আমি আড়াল থেকে খেয়াল করে শুনছিলাম। আসলাম ওই ছেলেটাকে বলছিল, ‘এই তোর মানিক স্যারের খাওয়া কই আজ? সেতো নেই। আমাদের দে। তোদেরটা খাবো, আবার তোদেরই গোল দেবো।’
আমি ক্লাবে যাওয়ার পর সবাইকে কথাটা বললাম। সবাই তো জিদ করলো। কি? আসলাম আমাদেরটা খেয়ে আমাদের গোল দিতে চেয়েছে। ঠিক আছে। দেখা যাবে। ওই ম্যাচে আমরা আসলামকে বলই ধরতে দেইনি। বাদল রায়ের গোলে আমরা ১-০ ব্যবধানে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।’
ক্লাব ফুটবলে শফিকুল ইসলাম মানিক মোহামেডান, আবাহনী, বাদার্সে খেলেছেন। ১৯৮৫ সালে ব্রাদার্সেও অধিনায়ক ছিলেন এই রাইটব্যাক। খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করে বেছে নিয়েছেন কোচিং পেশা। মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম আবাহনী হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের কোচ মানিক। জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন, ছিলেন বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলের কোচও।
আরআই/আইএইচএস/এসএএস/পিআর