>> স্বাস্থ্য এবং কৃষি মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনার বাইরে থাকবে।>> সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্পের অর্থব্যয় অব্যাহত থাকবে।
Advertisement
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রভাব পড়ার আগেই বেশ মন্দাভাব ছিল রাজস্ব আহরণে। ফলে সরকারের পরিচালনব্যয় মেটানোর পাশাপাশি উন্নয়নকার্যক্রম সচল রাখতে ব্যাংকঋণনির্ভরতা বাড়তে থাকে। এ অবস্থার মধ্যেই আসে করোনার মরণকামড়। এতে করে মারাত্মকভাবে কমতে থাকে রাজস্ব আয়ের গতি। ফলে অর্থসংস্থানের অভাবে বাজেট বাস্তবায়নে চাপ দেখা দেয়।
এ পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে বাস্তবায়নাধীন ‘নিম্ন অগ্রাধিকার’ বা কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থখরচ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে যৌক্তিক কারণে ব্যয় করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। পাশাপাশি ‘মধ্যম অগ্রাধিকার’ প্রকল্পের যেসব খাতে অর্থব্যয় না করলেই নয় এমন টাকা খরচের ক্ষেত্রে নিজস্বভাবে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্পের অর্থব্যয় অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এমন সব নির্দেশনা দিয়ে গত বুধবার (২২ এপ্রিল) একটি চিঠি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের কাছে পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ।
Advertisement
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) চূড়ান্ত হয়েছে। সে অনুযায়ী অর্থ বিভাগ থেকে গত ২৯ মার্চ পরিপত্র জারি করা হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে অগ্রাধিকার খাতসমূহে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হচ্ছে। সে প্রেক্ষিতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিম্নে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-
১. মন্ত্রণালয় বা বিভাগসমূহ তার আওতাধীন দফতরসমূহ বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের মধ্যে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার’ চিহ্নিত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে হবে।
২. মন্ত্রণালয় বা বিভাগসমূহ ‘মধ্যম অগ্রাধিকার’ চিহ্নিত প্রকল্পসমূহের ক্ষেত্রে প্রকল্পের যে সকল খাতে অর্থ ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী, মন্ত্রণালয় বা বিভাগসমূহ স্বীয় বিবেচনায় সে সকল খাতে অর্থ ব্যয় করবে।
৩. মন্ত্রণালয় বা বিভাগসমূহ ‘নিম্ন অগ্রাধিকার’ প্রকল্পসমূহের অর্থছাড় বা ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের পূর্বসম্মতি গ্রহণ করবে। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহ এই নির্দেশনার আওতাবহির্ভূত থাকবে। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
Advertisement
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় বেড়ে গেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির জন্য এক লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এসব অর্থের সংস্থান বাজেটে ছিল না। তাছাড়া এবার বাজেটে শুরুত থেকেই রাজস্ব আহরণ খারাপ। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ তাই রাজস্ব আদায় আরও কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই নিম্ন অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পে অর্থছাড় না করা এবং মধ্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্পে অর্থছাড়া সীমিত করার নতুন এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের গতি আনতে অর্থছাড়ের সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি)। অর্থাৎ অর্থ মন্ত্রণালয় বা প্রকল্পসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন বা সম্মতি ছাড়াই সরকারি তহবিলের (জিওবি) অংশের শতভাগ অর্থছাড় করতে পারবেন তারা। এমনকি ইচ্ছামতো খরচও করতে পারবেন। এর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা পরিবর্তন করে নতুন এ আদেশ জারি করা হয়েছে।’
এদিকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে শিল্পঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়াও করোনায় মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
যদিও এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের অধিকাংশ টাকার সংস্থানই হবে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। এরপরও প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণে সুদ ভুর্তকি বাবদ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সংস্থান বাজেট থেকে হবে। এছাড়াও গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা, স্বাস্থ্যখাতের জন্য অতিরিক্ত ২৫০ কোটি টাকাসহ বেশ কিছু টাকা বাজেট থেকে সংস্থান করা হবে।
এই মুহূর্তে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ না দেয়ার পক্ষে একমত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। এ বিষয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংকট বিবেচনায় চলতি ও আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার কমানো যেতে পারে। অগ্রাধিকারযুক্ত প্রকল্পগুলোতে গুরুত্ব বেশি দিয়ে কম অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো বাদ দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, মানুষকে রক্ষা করতে হলে চলতি ও আগামী বাজেটকে সাধারণভাবে চিন্তা করলে চলবে না। বর্তমানে একটা জরুরি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এটা অনিশ্চিত যে কতদিন এভাবে চলবে সেটা কারও জানা নেই।
তিনি বলেন, প্রতিবছরই কিছু অলংকারধর্মী কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। যেমন ট্রেনিং প্রোগ্রাম, যেগুলো এ বছর না হলেও চলবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশভ্রমণ, বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান যেগুলোর প্রয়োজন নেই, সেগুলো বাদ দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে খাদ্যনিরাপত্তা ঠিক রাখতে হবে। একইসঙ্গে বেশি বেশি অর্থ স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা নিরাপত্তায় ব্যয় করতে হবে।
ড. নাজনীন আহমেদ আরও বলেন, করোনা চলে গেলেই শেষ হয়ে গেল তা নয়। করোনা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে যে স্বাস্থ্যখাতে আমাদের আরও অগ্রগতি দরকার। চলমান বাজেটে রাজস্ব আদায় খুব খারাপ ছিল, এখন আরও খারাপ হবে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ইতোমধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে অনেক টাকা ধার করেছে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ থেকে তহবিল সংগ্রহে ভালো প্রস্তুতি থাকা দরকার। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এসব দাতা সংস্থার সাথে যেন সরকার নেগোশিয়েট করতে পারে।
এদিকে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের মহামারিতে বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তাই তিনি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছে আরও বেশি বেশি আর্থিক সহায়তার অনুরোধ করেছেন।
একইভাবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছেও অধিক হারে সহায়তার জন্য সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এমইউএইচ/বিএ/জেআইএম