মৃত্যুকে ছুঁয়ে এসেছেন করোনায় আক্রান্ত মার্কিন নার্স এলিজাবেথ স্নাইডার। এপ্রিলের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটলের বাসিন্দা ৪৯ বছর বয়সী এলিজাবেথের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এক পর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। করোনারে সঙ্গে লড়াই শেষে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
Advertisement
তবে চিকিৎসক বলে দিয়েছেন পুরোপুরি সুস্থ হতে তিন থেকে ছয় মাস লেগে যেতে পারে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে করোনাজয়ের সেই গল্প শুনিয়েছেন এলিজাবেথ। নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, যেন মৃত্যুকে তিনি ছুঁয়ে এসেছেন।
আক্রান্ত হওয়ার শুরুর দিকে এলিজাবেথ তেমন কিছু বুঝতে পারেননি। তেমন একটা উপসর্গ ছিল না তার মধ্যে। পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দিনটি ছিল শুক্রবার। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ক্লান্ত লাগছিল। যখন বিছানায় গেলাম নিজেকে খুব অবসন্ন মনে হলো। কঠিন একটা সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল সেটি। সোমবার আমি পায়ে ব্যথা বোধ করতে লাগলাম। ক্রমাগত তা দুঃসহ যন্ত্রণার হয়ে উঠলো’।
এলিজাবেথ বিবিসিকে আরও বলেন, ‘আমি ভেবেছি স্নায়ুর সমস্যার কারণে এ ব্যথা হচ্ছে এবং কিছু প্যারাসিটামল খেলাম। অবশ্য পরে চিকিৎসকদের কাছ থেকে জেনেছিলাম যে ভাইরাস সরাসরি আমার মাংসপেশীতে ঢুকে গিয়েছিল। আমার একটু কাশি ছিল ঠিকই তবে সেটাকে করোনার উপসর্গ মনে করার মতো কিছু ছিল না।
Advertisement
এক সপ্তাহ ধরে আমি বিছানায় পড়ে থাকলাম। একটু সুস্থ বোধ করার পর আমি স্থানীয় পেট্রোল পাম্পে গিয়েছিলাম আর তখন থেকেই ভাইরাসটি আমার ওপর চড়াও হয়। বাড়িতে ফিরলাম যখন তখন খুব ঠাণ্ডা বোধ হচ্ছিল, কাঁপছিলাম আমি। সোফায় চারটি গরম পানির বোতল ও কম্বল নিয়েও নিজের শরীরকে উষ্ণ করতে পারছিলাম না। এরপর জ্বর এলো’।
জ্বর আসার পরবর্তী সময়ের বর্ণনা দিয়ে এলিজাবেথ বলেন, ‘মনে হচ্ছিল আমার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ব্যথায় মনে হচ্ছিল মাথা দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কিছুই খেতে পারছিলাম না। বমি হচ্ছিল, ঘামছিলাম। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমার অ্যাজমা আছে। এজন্য আরও ভয় হচ্ছিল। তারপরও মনে হচ্ছিল বাড়িতেই হয়তো সেরে উঠব’।
বিবিসিকে এলিজাবেথ জানান, তিনি আরও কয়েকদিন বাড়িতে ছিলেন। এরপর একদিন জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যান। তার ১৫ বছর বয়সী বড় ছেলে ১১১ নম্বরে (যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের নন ইমার্জেন্সি নাম্বার) ফোন করে সহায়তা চাইলে অ্যাম্বুলেন্সে করে প্যারামেডিকরা বাসায় আসে। অক্সিজের মাস্ক পরিয়ে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর পেয়ে তার মা তার বাড়িতে এসেছিলেন। কিন্তু মায়ের পক্ষে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। কারণ তিনি হৃদরোগী। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার বিপদটা আরও বেশি।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পরের পরিস্থিতি সম্পর্কে এলিজাবেথ জানান, হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সের বিশাল লাইন পড়ে গিয়েছিল। তাকে নামানো পর্যন্ত তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। ভর্তি হওয়ার পর তার শরীরে করোনা পরীক্ষা করা হয়। রক্ত পরীক্ষা আর বুকের এক্সরে করা হয়। পরে এক নার্স তাকে জানান তার এক্সরে রিপোর্ট পাওয়া গেছে এবং তার নিউমোনিয়া হয়েছে। ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা এলিজাবেথকে অক্সিজেন নিতে হবে বলেও জানানো হয়।
Advertisement
এলিজাবেথ যে ওয়ার্ডে ছিলেন, সেখানে ছিল চারটি বেড। চার রোগীই ছিলেন করোনায় আক্রান্ত। ‘দুই নারী আমি যাওয়ার আগে থেকেই ওখানে ছিলেন। তাদের ডায়াবেটিসও ছিল। আর তৃতীয় নারীকে নিয়ে আসা হয় আমি যাওয়ার কয়েকদিন পর। আমার বিপরীত দিকের বেডেই ছিলেন তিনি। বলেন এলিজাবেথ।
তিনি জানান, কয়েকদিন পর হঠাৎ জানতে পারেন বিপরীতের বেডে থাকা ওই রোগীর অবস্থা মুমূর্ষু। এলিজাবেথের মনে হলো মাত্র ছয় ফুট দূরত্বে থাকা মানুষটি মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ‘এরপর আমার হ্যালুসিনেশন হতে লাগলো। আমার জীবনে যত মানুষের সাথে দেখা ও কথা হয়েছে সেগুলো কানে বাজতে লাগলো। একবার আমি ভাবলাম বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি।
অতীতের সে কথোপকথন শুনতে পাওয়ার মানে কি আমি মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছি? এটা কি সেই জিনিস যা মানুষ মৃত্যুর আগে শুনতে পাওয়ার কথা বলে থাকে? এরপরই আমি নিজেকে বোঝালাম যে না আমি মরে যাইনি। কারণ এখানে কোনও সাদা আলো নেই, কোনও দেবদূত নেই, কেউ আমাকে ডাকছেও না। তারপর হঠাৎ ভোরবেলা আমি শুনলাম এক পুরুষ নার্স বলছেন তিনি মারা গেছেন। আমার বিপরীতে থাকা রোগীটি আর বেঁচে নেই’।
এলিজাবেথ জানান, ওই নারী আগেই কোমায় চলে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর তিনিও মারা গেলেন। বেঁচে থাকলেন তিনি আর তার পাশে থাকা নারী। সে নারী বললেন, ‘এটি এমন এক ওয়ার্ড যেখানে ৫০ ভাগ রোগী মারা যায় আর ৫০ ভাগ রোগী বেঁচে থাকে। আমরা এ কক্ষের ভাগ্যবানদের অংশ’।
এলিজাবেথ বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য আমি লড়াই করে গেছি। শুরুতে অনেকখানি হাল ছেড়ে দিলেও পরে আমি নিজেকে বুঝিয়েছি যে আমার এখনই যাওয়ার সময় হয়নি। আমার বয়স ৪৯ বছর। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নই। শুধু আমার জন্য নয়, বাচ্চা, পরিবার ও বন্ধুদের জন্য বেঁচে থাকতে হবে।
তারপর একদিন চিকিৎসক তাকে জানালেন, তিনি বাড়ি ফিরতে পারেন। নিউমোনিয়ায় থাকায় তিন থেকে ছয় মাস তাকে বিশ্রাম নিতে হবে। তার ভাষ্য, ‘আমি মৃত্যুকে ছুঁয়েছি। বেঁচে থাকাটা আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার। এখন প্রকৃতির কাছে ফিরে ফিরে যাই। (যেখানে গেলে) আপনি উপলব্ধি করবেন বস্তুগত চাওয়া-পাওয়া আসলে কিছুই নয়। যখন বাইরে যাই প্রাণভরে শ্বাস নিই, পাখি দেখি, উপভোগ করি প্রকৃতির (অবারিত) সৌন্দর্য। এ যেন আমার দ্বিতীয় জীবন’।
এমআরএম/পিআর