ঢাকা থেকে পালিয়ে কুষ্টিয়ায় আসার সময় পথিমধ্যে রাজবাড়ী জেলায় পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত স্বামী-স্ত্রী। রাজবাড়ী জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ আক্রান্ত ওই দম্পতিকে তাদের জেলায় চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় এ নিয়ে কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ী জেলার মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। দফায় দফায় আলোচনা ও নানা ঘটনার পর শেষ পর্যন্ত শুক্রবার রাতে ওই দম্পতির ঠাঁই হয়েছে কুষ্টিয়া জেলায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসোলেশন ওয়ার্ডে।
Advertisement
আক্রান্ত ওই দম্পতি তাদের পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর এলাকায় বসবাস করেন। পেশায় প্রাইভেটকার চালক ওই ব্যক্তি কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর গ্রামের বাসিন্দা।
শুক্রবার রাতে অ্যাম্বুলেন্সে কুষ্টিয়ায় আসার পথে মুঠোফোনে কথা হয় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি জানান, গত ১৬ এপ্রিল হঠাৎ করে তার স্ত্রী জ্বরে আক্রান্ত হন। ওষুধ খাওয়ার পর তিনদিনের মাথায় জ্বর ভালো হয় যায়। শুধু কাশি থেকে যায়। স্ত্রীর জ্বর ভালো হয়ে গেলে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। দু’দিনের মধ্যে তার জ্বরও ভালো হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রী দু’জনের জ্বর হওয়ার বিষয়টি তিনি তার গাড়ির মালিক সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ওমর ফারুককে জানালে তিনি তাদেরকে করোনা টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন।
১৯ এপ্রিল তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে আসেন। একদিন পর ২১ এপ্রিল সেখান থেকে জানানো হয় তার করোনা পজিটিভ। পরদিন ২২ এপ্রিল স্ত্রী আর মেয়েরও করোনা পরীক্ষা করানো হয়। ২৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাসপাতাল থেকে মুঠোফোনে জানিয়ে দেওয়া হয় তার স্ত্রীও করোনা পজিটিভ। তবে মেয়ের রিপোর্ট নেগেটিভ।
Advertisement
তবে তারা কিভাবে কার সংস্পর্শে এসে করোনায় আক্রান্ত হলেন তা জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে তিনি স্বপরিবারে বাসাতেই অবস্থান করছিলেন। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে তিনি প্রাইভেটকার চালানোর ডিউটি থেকেও বিরত ছিলেন। তবে তিনি যেখানে বসবাস করেন সেই কামরাঙ্গীর চর এলাকাটা অনেক ঘিঞ্জি ও ঘনবসতিপূর্ণ। তার ধারণা এলাকার কারও সংস্পর্শে এসে তারা স্বামী-স্ত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
তিনি জানান, করোনা পজিটিভ হলেও তারা মোটামুটি সুস্থ। তাদের শরীরে তেমন কোনো উপসর্গ নেই।
ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় আসার কারণ কী জানতে চাইলে বলেন, মেয়েকে কে দেখবে? দু’জনই যেহেতু আক্রান্ত, মেয়ের কথা চিন্তা করেই মূলত তারা কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
তফিকুল জানান, শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে ঢাকা থেকে ভেঙে ভেঙে কখনো ট্রাকে করে আবার অটোতে করে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে এসে পৌঁছান বিকেল ৫টার দিকে। ফেরিতে করে রাজবাড়ী বড়পুল এলাকায় এসে পৌঁছালে পুলিশের হাতে আটক হন।
Advertisement
এ সময় জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশের কাছে তাদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে যেতে দেওয়ার অনুরোধ করেন। রাজবাড়ী জেলায় পুলিশের হাতে করোনা আক্রান্ত স্বামী-স্ত্রী আটক হওয়ার পর এ নিয়ে সেখানে তোলপাড় শুরু হয়। করোনা আক্রান্ত স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যায় পুলিশ।
রাজবাড়ী জেলার স্বাস্থ্য বিভাগও আক্রান্ত স্বামী-স্ত্রীকে তাদের জেলায় চিকিৎসা প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়। উপায়ান্তর না পেয়ে পুলিশ তাদেরকে ঢাকায় ফেরৎ পাঠানোর উদ্যোগ নিলে তারা ঢাকায় ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বিষয়টি কুষ্টিয়ার সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেন। কিন্তু কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জনও ঢাকাফেরত করোনা আক্রান্ত স্বামী-স্ত্রীকে কুষ্টিয়ায় ঢুকতে দেবেন না বলে অনঢ় থাকেন। কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম রাজবাড়ী জেলার প্রশাসনকে অনুরোধ করেন তাদেরকে ঢাকায় ফেরত পাঠানোর জন্য। কিন্তু আক্রান্ত স্বামী-স্ত্রী কোনোভাবেই ঢাকায় ফিরে যেতে রাজী হননি।
বিকেল থেকে অন্তত দুই-তিন ঘণ্টা দফায় দফায় এ নিয়ে রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়া জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জন মুঠোফোনে আলোচনা করেন। শেষ পর্যন্ত কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম সরোয়ার জাহান বাদশার অনুরোধে মানবিক দিক বিবেচনায় আক্রান্ত স্বামী-স্ত্রীকে কুষ্টিয়া জেলায় ঢুকতে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত জানান, আমরা কেউই চাই না আক্রান্ত অন্য কোনো ব্যক্তি আমাদের জেলায় ঢুকে পড়ুক। কিন্তু অনেক সময় অনুরোধে এবং মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে হয়। আক্রান্ত স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটিই হয়েছে।
রাজবাড়ী জেলার সিভিল সার্জন নূরুল ইসলাম জানান, দুই জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জনের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে যেহেতু তাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায় তাই সার্বিক বিষয় বিবেচনায় তাদেরকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে কুষ্টিয়ায় পাঠানো হয়েছে।
রাজবাড়ী জেলার সিভিল সার্জন মন্তব্য করেন, এভাবে করোনা আক্রান্ত রোগী পালিয়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় আসার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম জানান, শুক্রবার রাত ৯টার দিকে আক্রান্ত স্বামী-স্ত্রী রাজবাড়ী জেলা থেকে এ্যাম্বুলেন্সে কুষ্টিয়ায় এসে পৌঁছানোর পর তাদেরকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনকে দিয়ে কুষ্টিয়া জেলায় শুক্রবার পর্যন্ত করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৭।
আল-মামুন সাগর/এফএ/পিআর