বর্তমানে কোডিভ-১৯ বৈশ্বিক মহামারির পেছনে দায়ী সার্স-কভ-২ ভাইরাসটির মধ্যে কিছু পরিবর্তনের ফলে ইতোমধ্যে তার রোগসৃষ্টির ক্ষমতা অনেকখানি পরিবর্তিত হয়েছে বলে গবেষণায় দেখিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক ড. মুশতাক ইবনে আয়ূব। তবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কোন ধরনের সংক্রমণ হয়েছে সেটাই এখনো অজানা রয়েছে বলে দাবি করেছেন এ গবেষক।
Advertisement
করোনাভাইরাস নিয়ে গত ১৯ এপ্রিল প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে এই দাবি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপক ড. মুশতাক ইবনে আয়ূব।
তিনি গবেষণায় দেখিয়েছেন, ভাইরাসটির জিনোমে পর পর তিনটি গঠন উপাদান পরিবর্তনের ফলে এর সংক্রমণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। পৃথিবীর যেসব দেশে এই পরিবর্তন হয়ে যাওয়া ভাইরাসগুলো বেশি পরিমাণে আছে, সেখানে তুলনামূলকভাবে কম লোক আক্রান্ত হচ্ছে।
ড. মুশতাক বলেন, সার্স-কভ-২-এর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার ব্লুপ্রিন্ট হচ্ছে এর জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল আরএনএ। এই আরএনএর ভেতর মিউটেশনের মাধ্যমে শত শত পরিবর্তন হয়েছে এরই মধ্যে। কিন্তু এ পরিবর্তনগুলোর ভেতরে কেবল একটি ক্ষেত্র আছে, যেখানে ধারাবাহিক তিনটি অবস্থানে ভাইরাসের জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং এটি একটি অনন্য বিষয়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ওই তিনটি পরিবর্তন ভাইরাসের এমন একটি উপাদানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যেটা তার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন নামে পরিচিত ওই উপাদানটি একটি ভাইরাস থেকে অনেকগুলো ভাইরাস তৈরি হওয়া এবং নতুন নতুন কোষকে আক্রমণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ।
Advertisement
তিনি বলেন, অনেক বিজ্ঞানীই সার্স-কভ-২ ভাইরাসকে নানানভাবে শ্রেণিবিন্যাস করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমার গবেষণাটি পুরো বিষয়টিকে অনেকখানি সহজ করে তুলে ধরেছে। পর পর তিনটি পরিবর্তনকে ভিত্তি করে আমি শ্রেণিবিন্যাস করছি এবং এ রকম ঘটনা ভাইরাসের জিনোমের ত্রিশ হাজার বেস পেয়ারের ভেতর কেবল ওই তিনটি ধারাবাহিক অবস্থানেই ঘটে, আর সব ক্ষেত্রে সাধারণত আলাদা আলাদা করে একটি করে অবস্থানে পরিবর্তন হয়। তাই আমার শ্রেণিবিন্যাসটি একটি স্থিতিশীল ভিত্তি দিচ্ছে যার আলোকে ভাইরাসের অন্যান্য পরিবর্তনগুলোকে অনুসরণ করে তাদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ এবং ফলাফল বিশ্লেষণ করা সহজতর করে তুলবে।
ছবিতে সার্স-কভ-২ এর জিনোমে একটি বিশেষ মিউটেশন কালো তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে। ভাইরাসের জিনোমের ২৮৮৮১-২৮৮৮৩ অবস্থানে GGG এর অবস্থানে AAC পরিবর্তন এসেছে। ইউরোপের যেসব দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম সেখানে GGG এর অবস্থানে AAC এর পরিবর্তন বেশি দেখা যায়। এরকম আরও পাঁচটি পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে সার্স-কভ-২ এর সংক্রমণ ও রোগসৃষ্টির ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
এই গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এখানে দেখানো হয়েছে, পৃথিবীর যেসব দেশে এই পরিবর্তন হয়ে যাওয়া ভাইরাসগুলো বেশি পরিমাণে আছে, সেখানে তুলনামূলকভাবে কম লোক আক্রান্ত হচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোর ভেতর জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি এসব জায়গায় করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেশি। অপরদিকে পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম এসব দেশে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এই দেশগুলোতে ভাইরাসের জিনোমে উল্লিখিত পরিবর্তনগুলো বেশি হয়েছে।
শুধু আক্রান্তের সংখ্যাই নয়, বরং এই গবেষণায় বিভিন্ন দেশে কেন করোনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার বড় তারতম্য হচ্ছে তাও ব্যাখ্যা করেছেন ড. মুশতাক। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে কিংবা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে করোনার প্রকোপ কমবেশি হওয়ার পেছনে তিনি তার গবেষণায় পাওয়া মিউটেশনগুলোকে দায়ী বলে মত প্রকাশ করেছেন।
Advertisement
ড. মুশতাক বলেন, তার গবেষণাটি বাংলাদেশে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের জেনেটিক তথ্য জানার গুরুত্ব নতুন করে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশে কোন ধরনের সংক্রমণ-ক্ষমতার ভাইরাইস আছে সেটি জানা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে আমরা এই সংক্রমণের গতি প্রকৃতি আরও নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবো। সরকারকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ তাদের শতাধিক ভাইরাসের জিনোম তথ্য উদঘাটন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে একটিও হয়নি। দেশের বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের নিয়ে এখনই কাজটি করা দরকার বলে তিনি গুরুত্বারোপ করেন। একই সঙ্গে তিনি দেশের তরুণদের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান।
এ গবেষক বলেন, যেহেতু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার ভাইরাসের জিনোম তথ্য পাবলিক ডেটাবেসে পাওয়া যাচ্ছে, তাই এই তথ্য ব্যবহার করে আমাদের তরুণদের পক্ষে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা সম্ভব ।
ড. মুশতাক ইবনে আয়ূবের গবেষণাপত্রটি একটি বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশের জন্য জমা দেয়া হয়েছে। এর একটি খসড়া এখানে পাওয়া যাচ্ছে- www.preprints.org/manuscript
আল-সাদী ভূঁইয়া/এমএসএইচ/এমএস