প্রবাস

সম্পর্ক হোক সহমর্মিতার

সাইফ তমাল, সিঙ্গাপুর থেকে

Advertisement

আরামদায়ক জীবনযাপনের জন্য মানুষ কতকিছুই না করে। বিশাল বিশাল বাড়ি বানিয়ে বিনোদনের সব আখড়া বসায়। ব্যক্তিগত বাংলো। বাড়ি-গাড়ি, সুইমিংপুল আরও কতকিছু থাকে তার কোনো শেষ নেই।

ব্যক্তিগত জীবন চলায় নিরাপত্তা কর্মী রাখে। খাবার পর মুখে লেগে থাকা উচ্ছিষ্ট অংশ মুছে দেওয়ার জন্যও লোক থাকে। পায়ের জুতা পরতে রাখে ব্যক্তিগত কর্মী। আবার কেউ গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে কখন আসবে সম্মানী ব্যক্তিটি।

আকাশ-বাতাস, মাটি, জল সবই আমাদের একই। যে বৃক্ষরাজি বেঁচে থাকার চালিকাশক্তি হিসেবে অক্সিজেন দেয় সেটাও একই। মৃত্যুর পর সবাই আমরা একই মাটিতে শুয়ে থাকবো। অথচ অর্থের বড়াই করে মাটিতে পা ফেলতে দ্বিধা করি।

Advertisement

দিন কাটে সবার। যে জীবনে কষ্ট কি, অভাব কি জানে না তারও যেমন দিন কাটছে। আবার যে দিন আনে দিন খায় তারও দিন কাটছে। গরীব-দুঃখিদের দিন কাটানোর চিত্র ভিন্ন সবসময়। কতটা রাত যে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে দেয় তার কোনো হিসাব নেই। এমনও মানুষ আছে সারাদিন একবেলাও খেতে পারে না। না খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে দিন পার করে দেয়। আবার কেউ আছে নিজের ইচ্ছায় খাবারের অপচয় করে। তাদের ফেলে দেওয়া খাবার দিয়ে অনেক পরিবার অনায়াসে ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে।

বেঁচে থাকতে ভেদাভেদের শেষ নেই! শরীরের চামড়ার ভেদাভেদ। গায়ের জামার রঙ্গের ভেদাভেদ। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভেদাভেদ। এতসব ভেদাভেদ আস্তে আস্তে শেষ করে দিচ্ছে মানবসভ্যতা। সহানুভূতির হাত বাড়ানোর সমর্থ থেকেও আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকি।

আমাদের অনেক চাহিদা। আরও চাই। কোনোকালে চাওয়ার শেষ নেই। প্রতিযোগিতামূলক সম্পদের পাহাড় বানিয়ে বসে থাকি। সম্পদ হিসাব রাখার চিন্তায় নিজের অজান্তে শরীরে ধীরে ধীরে বাসা বাধে মরণব্যধি সব রোগ। সারাজীবনের অহংকার, অর্থ-সম্পদ কোথায় পড়ে রইল তার হিসাব রাখার সুস্থ মানসিক সময় থাকে না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে তখন বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা।

গরিব-দুঃখীদের পাওনার অধিক অর্থ রোগের চিকিৎসায় শেষ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন মরণব্যধিতে ধুকতে ধুকতে একটা সময় নিজেই শেষ হয়ে যায় হাসপাতালের বিছানায়। গচ্ছিত অর্থসম্পদ, রেখে যাওয়া আপজন সব হয়ে যায় পর।

Advertisement

এতকিছুর পরও মানুষের বড়াইকারী ভাব যেন কমতেই চায় না। গরীবের ক্ষুধার্ত পেটে লাথি দেয় হেলায়ফেলায়। ভুলে যাই সময় যখন শেষ হয়ে যায় যতো চেষ্টাই করা হোক এক সেকেন্ডের জন্য আয়েশি জীবন ফিরে আসে না। কার উপার্জিত সম্পদে কে হয় ভোগী। কে হয় মালিক? আসলে কেউ নয় মালিক! কেউ কারোর নয়। ভুলের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ভুলে যায় ভালমন্দ মানবিক বিচার।

পাশের বাড়ির যে পরিবারটি অনাহারে আছে, সামর্থ্য থাকলেও আমরা তাদের দিকে ফিরে তাকাই না। বিত্ত-বৈভবের চিন্তায় মনটাকে পাথর বানিয়ে ফেলেছি। খোঁজ নিলে জানা যাবে বিত্ত-বৈভবে ঠাসা পরিবারে মানসিক সুখ নেই।

যেখানে অর্থ মানসিক সুখ দিতে পারে না সেখানে অর্থ কি কাজে আসবে? হোমার বলেছিলেন ‘অসৎ আনন্দের চেয়ে পবিত্র বেদনা ভালো’ সত্যি তাই। পবিত্র বেদনা অনেক ভালো। মানুষের কল্যাণে কাজ করে যদি বেদনা পাওয়া যায় সেটা হবে পবিত্র বেদনা। পবিত্র বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকাটা আশির্বাদ।

হোটেলের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রুমে আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিনরাত্রি কাটিয়ে দিচ্ছি। সময়মতো তিন বেলা খাবার খেয়ে আবার বিছানায় শুয়ে থাকি। আছে দেওয়ালে লাগানো টেলিভিশন নামক নাচগান, রঙ্গতামাশায় ভরপুর আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্র। কোনকিছুই আর ভালো লাগে না। শুধু উন্মুক্ত আকাশের নিচে সবুজের মাঝে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার আখাঙ্খা ছটফটায়।

কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থেকে দিনরাত্রির কিছুই বুঝিনি। এখন একটি ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে বুঝতে পারি দিন আর রাত্রির মধ্যে কতটা দূরত্ব। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সকালের শুরু আর বিকালের শেষ। মাঝখানের সময়টা ব্যস্ত জীবনে ভাগ্য নির্ণয়ের।

কৃত্তিম বিনোদনের সকল ক্ষেত্র বন্ধ। মুগ্ধ করা পরিবেশ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। পার্কের বেঞ্চে পড়ে আছে ধুলোর আস্তরণ। বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে তার নিয়মে। ফুলের সুবাসে প্রফুল্ল হওয়ার পথিক নেই।

আজ ঘুমিয়ে পড়েছে ব্যস্ত পৃথিবী। কেউ কারোর নয়। কোন ক্ষমতায় সুখ নয়। বিপুলপরিমাণ অর্থসম্পদ অহংকার কোনকিছু দীর্ঘস্থায়ী নয়। দুর্যোগের এই খরা কাটিয়ে আমরা আবারও ফিরে আসবো সমহিমায়। ধনী আর গরিবের সম্পর্ক হোক সহমর্মিতায়, বন্ধুত্বে, ভালোবাসায়।

এমআরএম/এমকেএইচ