ভারতে নজিরবিহীন লকডাউনের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো দেশটির মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণি পুরো এক মাস গৃহপরিচারিকার সাহায্য ছাড়াই সংসার চালাতে বাধ্য হয়েছেন। রাজধানী দিল্লি ও তার আশেপাশে নানা বয়সের নারীরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে বেশ কষ্ট হলেও তারা এখন এই কাজের লোকবিহীন জীবনেই বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
Advertisement
পরিবারের সব সদস্যই বাড়ির কাজে হাত লাগাচ্ছেন; যা আগে তাদের হয়তো কখনও করতেই হয়নি। পাশাপাশি শ্রমিক নেতারা বলছেন, দিল্লিতে বহু পরিবার এখনও কাজের লোকদের গত মাসের বেতন দেননি; যা এই অসংগঠিত খাতের কর্মীদের প্রবল বিপদে ফেলেছে।
দিল্লির একটি বহুতল ভবনের বাসিন্দা ঋতুপর্ণা চ্যাটার্জি বলেন, প্রথম যখন হলো- মাথায় যেন বাজ পড়েছিল। কীভাবে এত কিছু ম্যানেজ করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
নতুন এক জীবনধারা
Advertisement
বস্তুত পশ্চিমা দুনিয়ায় একজন গৃহপরিচারিকা রাখতে পারাটা চরম বিলাসিতা বলেই ধরা হয়। কিন্তু ভারতীয় মধ্যবিত্তর কাছে এই কাজের লোক দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলা যেতে পারে। কিন্তু গত এক মাস ধরে বাড়ির রান্না, বাসন মাজা বা ঘর ঝাড়ামোছার কাজে তাদের সাহায্য পাওয়ার কোনও রাস্তা নেই। এ পরিস্থিতি মধ্যবিত্ত সংসারের কর্ত্রীদের নতুন এক জীবনধারায় অভ্যস্ত করে তুলেছে।
ঋতুপর্ণা চ্যাটার্জি বলছেন, তার সঙ্গে বৃদ্ধ বাবা-মা থাকেন, স্বামী এই মুহূর্তে কোয়ারেন্টিনে, একটা অল্প বয়সের ছেলে আছে। তাদের একেকজনের একেক রকম রান্না, বাজারহাট, তার ওপর নিজের অফিসের কাজ। সব মিলিয়ে যাকে বলে একেবারে নাজেহাল দশা। আর আগে কোনও দিন যেহেতু সবকিছু এভাবে একা একা করিনি, তাই আরও অসহায় লাগছিল।
ঋতুপর্ণা চ্যাটার্জি বলেন, এখনও অসুবিধা নিশ্চয় হচ্ছে। কিন্তু কী বলব, এক মাস পরে এসে এই নতুন জীবনটাই যেন রুটিন হয়ে গেছে।
কারও সঙ্গে খিটমিট নেই
Advertisement
দিল্লির কাছে গুরুগাঁওতে মেয়ে-জামাইকে সঙ্গে নিয়ে থাকেন সত্তর ছুঁই-ছুঁই কেয়া দে। তিনি বলেন, বাড়ির সবাই হাত লাগানোতে রোজকার কাজগুলো এখন আর তত কঠিন মনে হচ্ছে না। বাড়ির সবাই মিলে করছি বলেই কাজগুলো ঠিক উতরে যাচ্ছে। ওরা তো অনলাইনে কাজ করছে। তার ফাঁকে ফাঁকেই যে যখন পারছে এসে হাত লাগাচ্ছে।
কেয়া দে বলেন, আর একটা জিনিসও দেখছি, নিজেরা করলে কিন্তু অনেক তাড়াতাড়ি হয়, পরিষ্কারও থাকে। আবার কারও সঙ্গে কোনও খিটমিটও হয় না! তবে একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে আর তা হলো গৃহকর্মীদের বেতন। বামপন্থী শ্রমিক নেত্রী ও সাবেক এমপি বৃন্দা কারাট বিবিসিকে বলেন, দিল্লির বহু সচ্ছল পরিবারেও ছবিটা কিন্তু একেবারেই উল্টো।
বৃন্দা কারাটের কথায়, তারা তো ডোমেস্টিক ওয়ার্কারদের মাইনেই দিচ্ছে না। গতকালই আমরা দিল্লির জমরুদপুর ব্লকে গিয়ে সেটার প্রমাণ পেয়েছি। সেখানে মূলত ইউপি, বিহার থেকে আসা নারীরা লাজপাত নগরের মিডল ক্লাস ফ্যামিলিগুলোতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। কিন্তু মাইনে চেয়ে যোগাযোগ করতে গেলে তাদের মালিকরা কথাই বলছে না, ফোন পর্যন্ত ধরছে না।
তিনি বলেন, হ্যাঁ, কিছু কিছু বাড়ি নিশ্চয় পুরো টাকা মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করার সুবাদে আমরা যত কেস পেয়েছি, তার বেশিরভাগ তো টাকাই দিতে রাজি না। ফলে এই কঠিন সময়ে আমরা খুব ভাল করে জানি - অন্তত দিল্লি ও তার আশেপাশে - বেশির ভাগ গৃহকর্মীই কিন্তু খুব কঠিন সঙ্কটে আছেন।
বাসায় কোয়ালিটি টাইম
তবে এই প্রতিবেদনের জন্য যতজনের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা প্রত্যেকে নিজেদের গৃহকর্মীদের পুরো বেতন এর মধ্যেই মিটিয়ে দিয়েছেন। যেমন দিয়েছেন দিল্লির উপকণ্ঠে নয়ডার বাসিন্দা নূপুর গুপ্তা। পেশায় শিক্ষিকা, তাকে এখন রোজ অনলাইন ক্লাস নিতে হচ্ছে।
কিন্তু স্বামী ও বাচ্চারা নিজে থেকে এগিয়ে এসে ঘর মোছা বা বাসন মাজার দায়িত্ব কাঁধে নেয়ায় তিনিও অনেকটাই নিশ্চিন্ত।গুপ্তা বলেন, আমার স্বামী বা বাচ্চারা বারবার বলছে- তোমাকে ওগুলো নিয়ে ভাবতেই হবে না। আর আমি তো দেখছি, যখন ডোমেস্টিক হেল্পাররা ছিল তারচেয়ে এখনই পরিবারের সবাই মিলে অনেক বেশি কোয়ালিটি টাইম কাটাতে পারছি।
তবে গৃহপরিচারিকাদের ছাড়া জীবনে একটু আপসও যে করতে হচ্ছে না তা নয়। ডিনারে হয়তো এখন একটা বা দুটি পদেই খাওয়া সারতে হচ্ছে, ঘরবাড়িও ততটা ঝকঝকে তকতকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ঋতুপর্ণা চ্যাটার্জির মতে, স্বনির্ভরতার বোধটাই এখানে বড় প্রাপ্তি।
ভারতীয় মধ্যবিত্তর জীবনে এই ব্যতিক্রমী এক-দেড় মাস গৃহকর্মীদের জন্য কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে কি না, তা নিয়েও অনেকেই নিশ্চিত নন। বিবিসি বাংলা।
এসআইএস/এমকেএইচ