বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রায় তিন কোটি মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বের সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক অবনমন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় প্রায় ১০ কোটি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেবার বিষয়টিও তাই এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
Advertisement
সাহায্যকারী দেশসমূহের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা এই সঙ্কটময় মুহূর্তে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে সহায়তার পরিমাণকে হ্রাস করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বাস্তবিক অর্থে এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। করোনাভাইরাস বাংলাদেশের অর্থনীতির উপরও ক্রমান্বয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। বিশ্ব শ্রম সংস্থা (আইএলও), এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট কর্মজীবীদের প্রায় ৮০-৯০ ভাগই অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সাথে যুক্ত। তাই, লকডাউনে এই বৃহৎ সংখ্যক স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে ঘরে বসে প্রতিদিনের খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো প্রায় অসম্ভব।
অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কর্মরতদের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেই কেবল তাদের অধিকাংশের পক্ষে ঘরে থাকা, শারীরিক বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব মোতাবেক বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য গুদামে বর্তমানে প্রায় ১৬.৯৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য মজুত রয়েছে তন্মধ্যে চাল ১৩.৮৭ লাখ মে. টন এবং গম ৩.০৮ লাখ মে. টন। এই মজুদ সন্তোষজনক এবং খাদ্য শস্য ঘাটতির কোনো সম্ভাবনা নেই বলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক ‘খাদ্য শস্য পরিস্থিতি’ বিষয়ক এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
খাদ্য শস্যের পর্যাপ্ত মজুদ দেশের মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দিলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্য সবার কাছে পৌঁছে দেয়া এবং খাদ্য কেনার সামর্থ্য থাকার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মজুদকৃত খাদ্য দেশের মানুষের জন্য সরবরাহ করা হলেও অসাধু ব্যবসায়ী বা তৎসংশ্লিষ্ট কেউ যদি অন্যায়ভাবে তা মজুদ রাখে এবং দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তখন খাদ্যের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
Advertisement
বিশিষ্ট নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে শুধু খাদ্যের কম উৎপাদনই নয় বরং পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকার সত্ত্বেও যদি সুষম বণ্টন না হয় তবুও দুর্ভিক্ষ হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। তাই সংকটকালীন এ সময়ে দেশে মজুদকৃত খাদ্য সরবরাহের পর্যাপ্ততা, সুষম বণ্টন, স্বচ্ছতা এবং সহজেই পণ্য কেনার সামর্থ্যতার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জন্য রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করেছেন যেন তাদের অন্যতম মৌলিক চাহিদা খাদ্যের সমস্যায় পড়তে না হয়। পাশাপাশি আরও ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের জন্য জরুরি ভিত্তিতে রেশন কার্ড প্রস্তুতেরও নির্দেশনা দিয়েছেন।
খাদ্যের মজুদ বাড়াতে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান সংগ্রহের (২৬ এপ্রিল ২০২০ থেকে ৩১ আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত) লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে বোরো মৌসুমের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবজনিত এই সংকটকালীন মুহূর্তে হোম কোয়ারেন্টিন, লকডাউন ভেঙে ধান সংগ্রহ করার বিষয়টি সত্যিকার অর্থেই একটি বড়ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কার্যত: সবার সার্বিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, আমরা জানি বোরো মৌসুমের এই ধান বর্তমান দুর্যোগ মোকাবিলায় এবং ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই তো প্রধানমন্ত্রী উদ্ভূত পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে ধান কাটা শ্রমিকদের মাঠে যাওয়া সহজীকরণ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ প্রদান করা ছাড়াও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে এই কাজে সহায়তা করার লক্ষ্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
Advertisement
বোরো ধান কাটার সময় কৃষকদের প্রযুক্তির ব্যবহার করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। জমির আয়তন অনুযায়ী হারভেস্টার মেশিন ব্যবহার করে স্বল্প সংখ্যক কৃষক নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ধান কাটতে পারেন। এই মেশিনের মাধ্যমে একদিনে ৮-১০ একর জমির ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তায় সাজানো যায়। এতে প্রতি একরে ১২০০-১৫০০ টাকার ডিজেল খরচ হয়। তাই, করোনাকালীন সময়ে শ্রমিকের স্বল্পতা ও করোনা ঝুঁকি রোধে হারভেস্টার মেশিনের ভূমিকা অপরিসীম।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য পরিস্থিতির পাশাপাশি খাদ্য পরিস্থিতিও ক্রমশ: অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ও) প্রধান মহাপরিচালক টেড্রস আ্যাডহানম গ্রেব্রেইসুস যখন কোভিড-১৯ কে সোয়াইন ফ্লার চেয়েও দশ গুণ শক্তিশালী ক্ষতিকর ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে প্রদেয় আর্থিক সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।
যা এই মুহূর্তে সমগ্র বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্য সেবার বিবেচনায় অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ও হতাশাজনক একটি সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফ এ ও) এর ডিরেক্টর অব ইমারজেন্সিস ডোমিনিক কার্জন বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৃথিবীর কিছু স্থান দুর্ভিক্ষের খুব কাছাকাছি’। নিশ্চয় এ ধরনের ঘোষণা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার প্রসঙ্গকে চরম নাজুক অবস্থায় ফেলে দেয়। কেননা, খাদ্যের সংকট হলে মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নয় বরং খাবারের অভাবে না খেয়েই মারা যাবে।
তাই, প্রয়োজন পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রগুলোকে মতবিরোধ ভুলে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া। বিশেষজ্ঞরা এই মহামারিকে রুখতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার কথা বলছেন। যে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেকটি দেশের সমস্যা নিরুপন করত: সমস্যার ধরণ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সমাধান ও সহায়তা দিতে হবে। সমস্যার সমাধানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সফল দেশগুলোর তথ্যের অবাধ প্রবাহ বলবৎ রাখার পাশাপাশি তা যত দ্রুত সম্ভব সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে।
সম্প্রতি ভিয়েতনাম যেমন- স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক দুরত্বের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করে এটিএম বুথের মাধ্যমে জনগণকে চাল বিতরণ করেছে। এ প্রক্রিয়া সম্পাদনে চাল গ্রহণের পূর্বে হাত জীবাণুমুক্তকরণ এবং পরবর্তীতে নির্ধারিত বাটন চেপে বুথ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল নাগরিকদের সংগ্রহ করতে হয়েছে। সংকটময় এই মুহূর্তে ‘রাইস এটিএম বুথ’ প্রযুক্তির ব্যবহার করে ভিয়েতনাম শুধুমাত্র স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিই নিশ্চিত করেনি, বরং স্বচ্ছতার সাথে রাষ্ট্রের নাগরিকদের খাদ্যের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে।
সমগ্র বিশ্বের খাদ্যের অনিশ্চয়তা আমাদের দেশের জন্যও সুখকর কোনো বিষয় নয়। যদিও বাংলাদেশ সরকার খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ অর্থনৈতিক গতিশীলতার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। তথাপি সংকটকালীন এ সময়ে কৃষি কাঠামো সচল রাখতে শুধু কৃষকই নয় বরং খাদ্য উৎপাদনে সবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণের অনিবার্য প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর যত মানুষের এ অবধি মৃত্যু হয়েছে, সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যেন এর চেয়ে অধিক মানুষ দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ না করেন। করোনাভাইরাস মানব সভ্যতার প্রতি যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে তা মানব চর্চিত জ্ঞানের গভীরতা, বিচক্ষণতা, বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা এবং মানব শ্রেষ্ঠত্বকে প্রকৃতঅর্থেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এস. এম. আরিফ ইফতেখারপ্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১১০০।
এমআরএম