বিশেষ প্রতিবেদন

নতুন সাজে প্রাণ ফিরেছে শহীদ মতিউর পার্কে

ঊনসত্তরে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলনে নিহত মতিউরের নামে গুলিস্তানের পার্কটির নাম রাখা হয়েছিল৷ সেই শহীদ মতিউর পার্কটি ছিল একেবারে অবহেলিত। সময় কাটানো তো দূরের কথা, হাঁটাহাঁটি করার মতো পরিবেশও ছিল না। সেজন্য পার্কটিতে তেমন একটা দর্শনার্থীর দেখা মিলতো না। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের মাধ্যমে বর্তমানে পার্কটির আধুনিকায়ন হয়েছে। সংস্কারের ফলে নতুন সাজে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে পার্কটি।

Advertisement

স্থানীয়রা জানান, আগে দেয়ালঘেরা ৩ দশমিক ৫০ একর আয়তনের এই পার্কে বড় বড় গাছ ও মাঠে সবুজ ঘাস এবং চারপাশে বেঞ্চ থাকলেও নাগরিকদের ঘোরার পরিবেশ ছিল না। শুয়ে-বসে থাকতো ভাসমান মানুষ। ঘুরে বেড়াতো ছাগলের পাল। পার্কের মাঝে যে পুকুর, এর পানিতে ভাসতো ময়লা-আবর্জনা। পার্কের মাঝে আরেকটি কৃত্রিম পুকুর ছিল আবর্জনায় ভরা। দেয়াল ঘেঁষে জমে থাকতো আবর্জনার স্তূপ। কিন্তু এখন সেই অবহেলিত পার্ক পুরোপুরি বদলে গেছে।

সংস্কারের পর পার্কটি ঘুরে দেখা যায়, ভেতরের ফুটপাত আগের চেয়ে অনেক বেশি চওড়া করা হয়েছে। পার্কে বিভিন্ন রঙের বাতি স্থাপন করায় এর সৌন্দর্য বেড়ে গেছে অনেক গুণ। লাগানো হয়েছে বারমুডা প্রজাতির ঘাস। চারদিক বাগানবিলাস ও গাদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছে ছেয়ে গেছে। গাছগুলোর মধ্যে আছে ঝাউ, মেহগনি, পাতাবাহার, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস প্রভৃতি। এছাড়া আম, জামসহ বিভিন্ন ফল গাছও লাগানো হয়েছে। এখানে গাছপালা ও বারমুডা প্রজাতির ঘাস পরিচর্যায় দিনে তিন-চারবার পানি ছিটানো হয়। এছাড়া পার্কটির পূর্ব পাশে বঙ্গভবন সংলগ্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে দোতলা জিমনেসিয়াম। ব্যায়াম করার জন্য সব ধরনের সরঞ্জামও রয়েছে এখানে।

পার্কের ভেতরের পুকুরের দৃশ্য উপভোগের জন্য তৈরি হয়েছে বসার বেঞ্চ। চারদিকে পাড় বাঁধাই করে দেয়ার পাশাপাশি গোসলের জন্য রয়েছে একটি ঘাট। সরিয়ে দেয়া হয়েছে পার্কটির চারদিকের দেয়াল। ফলে এখন যেকোনো দিক দিয়ে পার্কে প্রবেশ করা যায়। ইতোমধ্যে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে পার্কটি। মাদকাসক্তদের আসরসহ অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে পার্কটিকে মুক্ত রাখতে এখানে সার্বক্ষণিক দায়িত্বে রয়েছে আনসার বাহিনী।

Advertisement

ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, পার্কের ভেতরে একটি ব্যাংকের বুথও স্থাপন করা হবে। এটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব সম্পত্তি। ১৯৯৭ সালে ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পার্কঘেঁষে নির্মাণ করা হয় ‘মহানগর নাট্যমঞ্চ’। এটি ভাড়া দিয়ে রাজস্ব পাচ্ছে ডিএসসিসি। ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় আধুনিকায়নের লক্ষ্যে পার্কটি সংস্কারে খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৬৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা।

পার্কটির বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের মাধ্যমে পার্কটির আধুনিকায়ন করা হয়েছে। গুলিস্তানের এই পার্কটি একসময় মাদকসেবীদের আখড়া ছিল। অসামাজিক কার্যকলাপের কারণে মানুষ হাঁটতে পারতো না। আমরা পার্কটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়ে পার্কের মধ্যে একটি বিশ্বমানের জিমনেসিয়াম তৈরি করে দিয়েছি। যাতে পার্কে হাঁটতে এসে মানুষ ব্যায়ামও করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের মাধ্যমে ডিএসসিসির মাঠ-পার্কগুলোর উন্নয়ন করছি। এ প্রকল্পের আওতায় আমরা মাঠ ও পার্কের দৃশ্য বদলে দিয়েছি। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এসব পার্ক ও খেলার মাঠগুলো আন্তর্জাতিক মানের করা হচ্ছে। পার্ক-মাঠের নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই ঢাকা। এরই মধ্যে অনেক মাঠের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

জানা গেছে, ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯টি পার্ক আর ১২টি খেলার মাঠ আধুনিকায়নের জন্য প্রকল্প হাতে নেন। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে নকশা পরিবর্তনের কারণে ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৭০০ কোটি ১৯ লাখ টাকায়। এই বরাদ্দের ৭০ শতাংশ দেয় সরকার, বাকি ৩০ শতাংশ বহন করে ডিএসসিসি।

Advertisement

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে আরও জানা গেছে, ডিএসসিসি এলাকায় মাঠ ও পার্কের উন্নয়নে গ্রহণ করা ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় ৩১টি মাঠ ও পার্কের নকশা প্রণয়ন করেন রফিক আযমের নেতৃত্বে ৭০ জন স্থপতি। মাঠগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ইতোমধ্যে সর্বসাধারণের জন্য খুলেও দেয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি মাঠ উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। মেয়র সাঈদ খোকনের মেয়াদকালেই (আগামী মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত) এ প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হচ্ছে।

প্রকল্পভুক্ত পার্ক ও মাঠগুলোর মধ্যে গুলিস্তানের শহীদ মতিউর পার্ক ছাড়াও রয়েছে মতিঝিলের সিরাজ উদ্দৌলা পার্ক, বংশালের ত্রিকোণাকার পার্ক, কলাবাগান খেলার মাঠ, গোলাপবাগ খেলার মাঠ, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা পার্ক, মালিটোলা পার্ক, সিক্কাটুলী পার্ক, মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পার্ক, আউটফল স্টাফ কোয়ার্টার শিশুপার্ক, বাসাবো মাঠ, শহীদ আব্দুল আলীম খেলার মাঠ, জোড় পুকুর মাঠ, রসুলবাগ পার্ক, বাহাদুরশাহ পার্ক, নবাবগঞ্জ পার্ক,গজমহল পার্ক, হাজারীবাগ পার্ক, বাংলাদেশ মাঠ, সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ, পান্থকুঞ্জ পার্ক, আজিমপুর শিশুপার্ক, শহীদনগর মিনি স্টেডিয়াম, সামসাবাদ খেলার মাঠ, দেলোয়ার হোসেন খেলার মাঠ, বালুরঘাট খেলার মাঠ, ওসমানী উদ্যান বা গোসস্যা নিবারণী পার্ক, বকশীবাজার পার্ক ও বশির উদ্দিন পার্ক।

প্রকল্পের আওতায় মাঠ বা পার্কগুলোতে যা থাকছেডিএসসিসি সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় মাঠ বা পার্কগুলোতে প্রায় একই রকম সুযোগ-সুবিধা থাকছে। এর বাইরে কোনো কোনোটিতে থাকছে এলইডি লাইটিং, কফি হাউজ, ফুড কোর্ট, কার পার্কিং, জাদুঘর, পাঠাগার, গ্রিন জোন, পাবলিক প্লাজা, লেডিস কর্নার, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, হাতিরঝিলের মতো জলাধারের পাশাপাশি সবুজ বাগান ও বেষ্টনী। গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের ভাস্কর্যও থাকছে। ফলে পরিবার নিয়ে বেড়ানোর জন্য মনোরম জায়গা হয়ে উঠছে একেকটি মাঠ ও পার্ক।

এএস/এইচএ/এমএস