জাতীয়

মাছ বিক্রিও করতে পারছেন না, খাবারও দিতে পারছেন না চাষীরা

ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহার তথ্যমতে, সারাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪২ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রতি বছর উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ দেশের প্রায় ১০ ভাগের একভাগ মাছ উৎপাদন হয় ময়মনসিংহে।

Advertisement

করোনা সংক্রমণের পর থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মাছ চাষীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে হাইব্রিড উপায়ে পাঙ্গাশ, কৈ, তেলাপিয়া, শিং, মাগুর, টেংড়াসহ নানা জাতের মাছ উৎপাদনকারীরা। সেই সঙ্গে মাছের হ্যাচারির মালিকরাও পড়েছেন সঙ্কটে। দেশি জাতের মাছ উৎপাদনকারীরাও এর বাইরে নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঙ্গাশ, কৈ, তেলাপিয়া, শিং, মাগুরসহ নানা জাতের হাইব্রিড মাছ চাষীরা অর্থের অভাবে মাছের খাবার দিতে পারছেন না। স্বাভাবিক সময়ে ১০-২০ শতাংশ নগদ অর্থ দিলে মাছের সব খাবার দিতেন ডিলাররা। এখন নগদ অর্থ ছাড়া মাছের খাদ্য দিচ্ছেন না তারা। অন্যদিকে ব্যাংক কিংবা অন্য কারও কাছ থেকে ঋণও পাচ্ছেন। ফলে অনেক চাষী মাছের খাদ্য দিতে পারছেন না।

সাধারণ সময়ে ময়মনসিংহ থেকে কৈ, পাঙ্গাশসহ অন্যান্য মাছ ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারাদেশে বিক্রি হতো। লকডাউনের পর থেকে কোনো পাইকার কিংবা চাষী ময়মনসিংহের বাইরে মাছ বিক্রির জন্য নিয়ে যেতে পারছেন না। ফলে মাছের দামও পাচ্ছেন না তারা। পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, কৈ মাছের দাম মণ প্রতি প্রায় ১ হাজার টাকা কমে গেছে। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে মাছের দাম আরও কমতে পারে। দাম না পাওয়ায় ইতোমধ্যে অনেকে মাছ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার মধ্যস্বত্বভোগীরা চাষীদের কাছ থেকে একেবারে কম দামে মাছ কেনার চেষ্টা করছেন। এছাড়া এসব হাইব্রিড মাছ খেলে করোনা হতে পারে– এমন গুজবও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলেছে চাষীদের।

Advertisement

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে মাছ চাষীরাও রয়েছেন। তাদের প্রণোদনা দেয়া হবে। তবে কী উপায়ে দেয়া হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। অন্যদিকে মাছ পরিবহন লকডাউনের আওতামুক্ত রয়েছে। কোথাও মাছের গাড়ি সমস্যায় পড়লে তারা সেটার সমাধান করে দিচ্ছেন। তবে মাছ চাষীরা কীভাবে খাদ্য কিনবেন, সেটার কোনো সমাধান দেখছেন না।

সোমবার (২০ এপ্রিল) ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ জেলা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাসমূহের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছি, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। কৃষি খাতে আরও বেশি। মাত্র ৪ শতাংশ সুদে আমরা কৃষি ঋণ দিচ্ছি। কৃষি মানে শুধু ধান ফলানো নয়। মৎস্য পোল্ট্রি, ডেইরি থেকে শুরু করে ফলমূল, ফুল যা যা আছে – সবকিছু মিলেই এই প্যাকেজ।’

এই করোনা সঙ্কটে মাছ চাষী, খাদ্যের ডিলার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কী ভাবছেন, কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন, বিস্তারিত তুলে ধরা হলো –

যা বলছেন মাছ চাষীরাফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ১১০ শতাংশ জমির পুকুরে প্রায় তিন লাখ কৈ মাছের পোনা ছাড়েন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার শিবরামপুর গ্রামের মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, তার মাছের এই চালান তুলতে প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা লাগবে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এক মাসের মধ্যে মাছগুলো বিক্রির উপযোগী হবে। এই সময় প্রায় ৮-৯ লাখ টাকার খাদ্যের প্রয়োজন হবে। কিন্তু গত ১৩ দিনে কোনো খাদ্য দিতে পারেননি। কারণ, ডিলার এখন আর নগদ টাকা ছাড়া মাছের খাদ্য দিচ্ছেন না।

Advertisement

রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে ১০-২০ শতাংশ টাকা দিলে মাছের খাদ্য দিত ডিলাররা। কিন্তু করোনার কারণে নগদ টাকা ছাড়া কোনো খাদ্য দিচ্ছে না। টাকার জোগাড় করতে না পারায় ১৩ দিন ধরে মাছকে খাবার দিতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘কৈ মাছকে খাবার না দিতে পারার আরেকটা সমস্যা আছে। বড় কৈ ছোট কৈ খেয়ে ফেলে। ফলে মাছ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্যদিকে খাবার দিতে না পারায় মাছের বৃদ্ধিও কমে গেছে। ’

একই উপজেলার রাজাবাড়ী গ্রামের শ্রীবাস চন্দ্র দাস চাষ করেছেন তেলাপিয়া মাছ। তার প্রায় ৭০-৮০ মণ তেলাপিয়া করোনা সংক্রমণের শুরু সময়ই বিক্রির উপযোগী হয়েছে। কিন্তু তেলাপিয়াসহ কৈ, শিং, মাগুর– হাইব্রিড জাতের এসব মাছ খেলে করোনা হয়, এমন গুজবের কারণে এতদিন মাছ কেনেননি পাইকাররা (মধ্যস্বত্বভোগী)। আড়তে নিলেও ফিরিয়ে আনতে হয়েছে তাকে। তবে পাইকাররা তেলাপিয়া মাছ বাজারে তুলতে বললে রোববার (১৯ এপ্রিল) বিক্রির জন্য মাছ তোলেন তিনি।

শ্রীবাস চন্দ্র দাস বলেন, ‘হাইব্রিড পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, কৈ, শিং– এ জাতীয় মাছ খেলে করোনা হয়, এটা ছড়িয়ে গেছে। কয়েক দিন বাজারে তেলাপিয়া বিক্রি করতে গেছিলাম। কিন্তু পাইকাররা নেয়নি। তিন সপ্তাহ পর আজকে বাজার থেকে খবর দিছে, এখন পাঠালাম।’

তিনি বলেন, ‘প্রায় ৭০-৮০ মণ তেলাপিয়া হবে আমাদের। যে বাজার ছিল ১৩০ টাকা কেজি, সেটা এখন ১০০-১০২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। যেটা ৪৮০০-৫০০০ টাকা মণ বিক্রি হতো, এখন সেটা ৩৫০০-৩৭০০ টাকা মণে হচ্ছে। পাঙ্গাশের আগে বাজার ছিল ৩৭০০-৩৯০০ টাকা মণ। এখন ২৫০০-২৭০০ টাকা মণ। অর্থাৎ তেলাপিয়া, পাঙ্গাশে মণপ্রতি প্রায় ১২০০-১৫০০ টাকা কমে গেছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দিন দিন মাছের দাম আরও কমতে থাকবে।'

‘আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ যেত, এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এক থেকে দেড় লাখ টাকার মাছ নিয়ে কেউ রিস্কে যেতে চায় না। তাই ময়মনসিংহের ভেতরেই কম দামে মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে’, যোগ করেন শ্রীবাস।

আলমগীর হোসেন নামের আরেক মাছ চাষী বলেন, ‘মাছ বিক্রির সময় করোনার প্রভাব পড়বেই। দূরে কোথাও মাছ নিয়ে বিক্রি করা যায় না। দূরে না নিয়ে গেলে দাম পাওয়া যায় না। তবে কী হয় বলা যাচ্ছে না। এ জন্যই বাকি খাদ্য দিচ্ছে না ডিলার। করোনায় কেউ মারা গেলে টাকা পাবে না। নানা কারণ।’

তিনি বলেন, ‘যত টাকার খাদ্য লাগে, তত টাকা তো একজন চাষীর পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। নতুন করে তো ঋণ পাওয়ারও সুযোগ নেই। এটা একটা বড় সমস্যা।’

কেন নগদ ছাড়া খাদ্য দিচ্ছেন না ডিলার?

মুক্তগাছা উপজেলার কালীবাড়ি বাজারের মাছের খাদ্যের ডিলার জয়নাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাষীদের কাছে যে টাকা-পয়সা ছাড়ছি, তারা তো মাছ বিক্রি করতে পারতেছে না। পার্টি মাছ নেয় না, বাজার খুব খারাপ, বাজারে মাছ খাচ্ছে না। বিক্রি না করতে পারার জন্য আমার কাছে ক্যাশ আসছে না। আমার কাছে যা ক্যাশ ছিল, সব শেষ করে ফেলছি। চাষীরাও কিছু কিছু দিছে, ওইটাও শেষ করছি। এখন আর টাকা নাই। অন্যদিকে কোম্পানি ক্যাশ ছাড়া খাদ্য দিচ্ছে না। তাই এখন আমিও চাষীদের নগদ টাকা ছাড়া খাদ্য দিতে পারতেছি না।’

বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত কথা হয় ময়মনসিংহের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সরকার একটা প্রণোদনা দিচ্ছে মাছ চাষীদের। ছোট, মাঝারি চাষী। তবে এটার ক্রাইটেরিয়াগুলো কী হবে, মন্ত্রণালয় থেকে এখনও সেই ধরনের কোনো নির্দেশনা পাইনি। কত একর পর্যন্ত মাছ চাষ করলে সে ছোট চাষী, কত একর হলে মাঝারি চাষী হবে ইত্যাদি। তাছাড়া আমাদের তো বিভিন্ন সমস্যা আছে। কেউ একটা পুকুর নিয়ে মাছ চাষ করছে, তার একটা ক্ষতিই বড় ক্ষতি। আবার দেখা যাচ্ছে, কারও ৩০টা পুকুর আছে, তার ক্ষতিটাও অনেক বড়। মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের একটা নীতিমালা করে দেবে, আমরা ছোট ও মাঝারি ক্যাটাগরির কথা বলেছি। হ্যাচারির নাম্বারগুলো আমরা ঠিক করে দিচ্ছি, নার্সারিগুলোর কাছ থেকে নিচ্ছি। পরে কৃষকদের কাছ থেকে নেব। গ্রাম পর্যায় থেকে তাদের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের পর প্রণোদনা দেয়া হবে।’

লকডাউন থাকলেও সারাদেশে মাছ সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা নেই। এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মাছ নিয়ে যাওয়ার সময় কোনো সমস্যায় পড়লে তা তারা সমাধান করেন বলেও জানিয়েছেন ময়মনসিংহের এই মৎস্য কর্মকর্তা।

দিলীপ কুমার সাহা বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে আমরা সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় মাছ পাঠিয়েছি। ঢাকা অফিসের একটা হটলাইন নম্বর আছে। সমস্যা হলে আমাদের জানালে ময়মনসিংহের ভেতরে হলে আমরা নিজেরাই তা সমাধান করছি। কিন্তু যখন জেলার বাইরে যাচ্ছে হ্যাচারি বা মাছের চালান, তখন আমাদের কিছু নম্বর আছে, তা উপজেলা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই তারা দিয়ে দেবে। কোথাও আটকা পড়লে আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই ওই উপজেলার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টার সমাধান করতে পারব।’

তবে কৈ, পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া চাষীরা যে টাকার অভাবে মাছের খাদ্য দিতে পারছেন না, এ বিষয়ে কোনো সমাধান দিতে পারেননি ময়মনসিংহ জেলার মৎস্য কর্মকর্তা।

পিডি/এএইচ/জেআইএম