করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইতিমধ্যেই সাড়ে সাত লাখ আক্রান্ত পার হয়ে গেছে দেশটিতে। মৃত্যু পার হয়েছে ৪০ হাজার। একই সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে বেকারত্ব বরণ করে নিয়েছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ।
Advertisement
অসংখ্য মানুষের এই কর্মহীন হয়ে পড়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে যাচ্ছে বিদেশিরা। কয়েকদিন আগেই সিএএন রিপোর্ট করেছিল, কাজ এবং ভিসা হারিয়ে দিশেহারা চাইনিজরা। এবার সে তালিকা যুক্ত হচ্ছে ভারতীয়রাও। করোনার কারণে কাজ এবং ভিসা হারিয়ে নিাদারুন সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয়রাও।
চীনের উহান থেকে গত বছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে করোনাভাইরাস। এরপর এখনও পর্যন্ত সারা বিশ্বের ২১০টিরও বেশি দেশ এবং অঞ্চলে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগেই একে মহামারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তবে মহামারির সঙ্গে সারা পৃথিবীতেই সৃষ্টি হয়েছে বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক অবস্থা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ছড়াতে শুরু করে মার্চের শেষ দশকে। অর্থ্যাৎ এখনও ১ মাস পার হয়নি। তাতেই পরো দেশ বিপর্যস্ত। বেকাত্বের হার ৩০০০ ভাগ। করোনার কারণে মার্কিনিরা কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হতে শুরু করে ১০ কিংবা ১১ মার্চ থেকে। এরপর থেকেই মূলতঃ দেশটিতে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
Advertisement
সুতরাং, মার্কিন কোম্পানিগুলোর পক্ষে তাদের বিদেশি কর্মীদের রেখে দেয়াও অসম্ভব। সামনের সপ্তাহগুলিতে মার্কিন সংস্থাগুলি তাদের ভারতীয় কর্মী যারা এইচওয়ান-বি ভিসাহোল্ডার, তাদেরকে ছাঁটাই করতে পারে বলে খবরে প্রকাশ পেয়েছে। ইতোমধ্যেই দুই থেকে আড়াই কোটি মানুষ নিজেদের বেকার বলে দাবি করে বেকারত্বের সুবিধা নিতে চাইছে আমেরিকান সরকারের কাছ থেকে। দেশটির শ্রম এবং সংখ্যাতত্ত্ব দপ্তরের নিয়মিতই এমন তথ্য জানাচ্ছে।
এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ভারতীয় কর্মীরা রয়েছেন অনেক বেশি ঝুঁকিতে। আমেরিকান বিখ্যাত আইটি কোম্পানিতে এইচওয়ান-বি ভিসায় কাজ করেন এমন একজন ভারতীয় আইটি ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘আমরা যারা যুক্তরাষ্ট্রে এইচওয়ানবি ভিসায় রয়েছি, তাদের সবাইকে চাকরি হারানোর বিষয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। এরপর যদি ৬০ দিনের মধ্যে অন্য কোনো চাকরি খুঁজে না পাই, তাহলে ভারতে ফিরে যাওয়ারও প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।’
এইচওয়ান-বি ওয়ার্কিং ভিসা নিয়ে যেসব কর্মী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন চাকরি চলে যাওয়ার পর, অটোমেটিক ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। এরপর তারা ৬০ দিন সময় পান নতুন চাকরি খুঁজে নিয়ে ভিসা নবায়ন করার। নতুবা আমেরিকা ছাড়তে হয় তাদেরকে।
অথবা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অতিরিক্ত থাকতে হবে। এই অতিরিক্ত থাকার সুযোগ পাওয়া যাবে ১৮০ দিন, তথা ৬ মাস। তবে, ভবিষ্যতে তিনি আর হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পারবে না। কারণ আমেরিকান আইন অনুযায়ী তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হবে।
Advertisement
কিন্তু করোনাভাইরাসে যখন পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপর্যস্ত, তখন নতুন কোনো চাকরিদাতা খুঁজে পাওয়া আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, কোনো চাকরিদাতাই এখন এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত খরচ কিংবা অতিরিক্ত কাজের ঝুঁকি মাথায় নিতে নারাজ।
কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমান সময়ে এসে ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিস (ইউএসসিআইএস) সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই ভিসাগুলোর মেয়াদ তারা সাময়িকভাবেও আর বাড়াবে না। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ও যদি কারো ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তবুও না।
এ কারণেই মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রে এইচওয়ান-বি ভিসায় কাজ করা ভারতীয়সহ বিদেশি নাগরিকরা পড়ে গেছেন গভীর অনিশ্চয়তায়। একে তো চাকরি হারিয়ে পুরোপুরি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়, নতুন চাকরি না পাওয়া, সর্বোপরি নতুন চাকরি না হলে ভিসাও হবে না, আর ভিসা না হলে পুরনো ভিসার মেয়াদও বাড়ানো হবে না বলে যে ঘোষণা ট্রাম্প প্রশাসন দিয়েছে, তাতে আমেরিকায় বিপুল পরিমাণ বিদেশি পড়ে যাচ্ছে গভীর অনিশ্চয়তায়।
এখনও পর্যন্ত যে খবর, তাতে দেখা যাচ্ছে ইতোমধ্যেই অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। কিন্তু বিদেশি নাগরিক, যারা এইচওয়ান-বি ভিসায় কাজ করছেন, তাদেরকে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করতে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় নাগরিকদের অস্থায়ীভাবে সবেতনে ছুটি দেওয়া হচ্ছে কিংবা কম সময় কাজ করতে বলা হচ্ছে।
এক পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি এইচওয়ান-বি ভিসা প্রোগ্রামের আওতায় রয়েছে ভারতীয়রাই। যাতে বিদেশ থেকে আসা বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন নন ইমিগ্রান্টদের কাজের অনুমতি দেওয়া হয় মার্কিন কোম্পানিগুলোতে। অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফটের মতো বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো দক্ষ কর্মী নিয়োগ করে এই এইচওয়ান-বি ভিসার আওতায়। ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আমেরিকান পলিসি অনুসারে, ক্রমশ বেকারত্ব বাড়ছে সেখানে, ২০১৫ সালে যেখানে ছিল ৬ শতাংশ সেখানে ২০১৯ সালে হয়েছে ২১ শতাংশ। আর করোনার কারণে তো সেটা এক লাফে ৩০০০ গুন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দিশেহারা অবস্থায় বিদেশি নাগরিকরা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে ইতিমধ্যেই দাবি তুলেছেন চাকরি না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রে থাকার অনুমতি ৬০ দিন থেকে বাড়িয়ে যেন ১৮০ দিন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ভারতীয়রা অনলাইন পিটিশনের মাধ্যমে এই আবেদন তুলে ধরেছেন হোয়াইটহাউজের কাছে। ইতিমধ্যেই প্রয়োজন ১ লাখ সিগনেচার জমা পড়েছে সেই পিটিশনে। হোয়াইটহাউজও এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছে।
আশার আলো দেখাচ্ছে ডিএইচএসভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে, ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিস (ইউএসসিআইএস) ভিসার মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করে সম্ভবত বিষয়টাতে এসে হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস)।
তারা জানিয়েছে, করোনা মহামারির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি ইমিগ্র্যান্টদের মহা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এরই মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরির সঙ্গে ভিসা স্ট্যাটাও হারিয়ে ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের হুট করে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোরও সুযোগ নেই, একই সঙ্গে নতুন চাকরি নিয়ে থাকারও সুযোগ হচ্ছে না। এমনকি হুট করে কারো দেশে ফিরে যাবারও সুযোগ নেই।
সুতরাং, এই পরিস্থিতি বিবেচনা করেন ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস) সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর। এ লক্ষ্যে তারা এইচওয়ান-বি ভিসা স্ট্যাটাস হারিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আবেদন গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। এমন এক সময়ে ডিএইচএসে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সব সীমান্ত এবং সব আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে।
ডিএইচএস জানিয়েছে, ‘আমাদের জানা আছে যে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে নন-ইমিগ্র্যান্টদের আমেরিকাতেই থাকতে হচ্ছে। সুতরাং, বিষয়টা যাতে অনুমোদিত হয়, সে কারণে যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাদের কাছ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে।’
ডিএইচএস জানিয়েছে, ‘আমরা এই ইস্যুটা খুব গুরুত্ব এবং যত্নের সাথে বিশ্লেষণ করছি। একই সঙ্গে ডিএইচএস আমেরিকান জনগনকে রক্ষা এবং তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভালোভাবে দেখভাল করছে।’
আইএইচএস/