‘আগে বাড়ি থেকে টাকা এনে আচার, চকলেট, চিপস, আইসক্রিম খেতাম। এখন আর খাই না। কারণ স্কুল থেকে প্রতিদিন খিচুরি, ডিম, ব্রেড দেয়া হয়। স্যারেরা এসব ভালো ভালো খাবার দেয়ায় আমরা খুবই খুশি পাশাপাশি লেখাপড়ায়ও মনোযোগ বেশি দিতে পারছি। কথাগুলো বলছিল নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা ইউনিয়নের বগাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তামান্না। তার মতো আরো অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। সবাই খুব খুশি বিদ্যালয় থেকে খাবার পেয়ে। সরেজমিনে দেখা গেছে, যথারীতি নিয়মে বিদ্যালয়ে চলছে পাঠদান। প্রতিটি শ্রেণি কক্ষে শিক্ষকগণ খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছে। আর শিক্ষার্থীরাও আনন্দের সঙ্গে সে সব পাঠদানে মনোনিবেশ করছে। বিশেষ করে বিদ্যালয়টির দো-তলায় প্রাক প্রাথমিক কক্ষে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের আরো বেশী যত্ন নিয়ে পাঠদান করাতে দেখা গেছে। প্রতিটি শিক্ষার্থী অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত ও আনন্দের সঙ্গে লেখাপড়া করছে। কখনো নেচে, কখনো গানের সুরে তাদের পাঠ দেয়া হচ্ছে। কথা হয় শ্রেণি শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি যেমন একজন মা আবার একজন শিক্ষক। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে চিন্তায় থাকি তারা দুপুরে কি খাবে। অথচ এ বিদ্যালয়ে আসা ছেলে-মেয়েদের এখন আর খাবারের জন্য চিন্তা করতে হয় না। অভিভাবকরাও থাকেন চিন্তামুক্ত। তিনি জানান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ড.রহিমা খাতুন ও স্থানীয়দের উদ্যোগে এ বিদ্যালয়ে সপ্তাহে ৫ দিনই প্রতিটি ছেলে-মেয়েকে পুষ্টিযুক্ত খিচুরি, ডিম, ব্রেড ও কলা দেয়া হয়। তারা প্রতিদিন বিদ্যালয় এসে আমাদের জিজ্ঞাসা করেন আজ কি খাবার দেয়া হবে ? আর এসব খাবার খেয়ে শিশুরা যেমন খুব খুশি আমাদেরও পাঠদান দিতে ভালো লাগে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বপ্না রানী দেবি জাগো নিউজকে জানান, বেশির ভাগ ছেলে-মেয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে আসে না। আর না খেয়ে আসার কারণে তারা লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না। মাসের পর মাস এভাবে না খেয়ে আসার কারণে এরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। পাশাপাশি বাড়ি থেকে টাকা এনে স্কুলের সামনে থেকে নিম্নমানের খাবার খাওয়ার কারণে পেটের অসুখ থাকে সব সময়। স্কুল থেকে খাবার দেয়ার কারণে তার বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখায় আরো বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে এবং দিন দিন উপস্থিতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোনাইমুড়ী উপজেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া জানান, মানসম্মত শিক্ষা তথা ঝরে পড়া রোধ ও পুষ্টিহীনতা রোধ করতে বিদ্যালয়গুলোতে মিড ডে মিল কার্যক্রম আরো আগেই চালু করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে উপজেলার সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ কার্যক্রম দ্রুত চালুর জন্য সমাজের বিত্তবানসহ শিক্ষানুরাগীর সহযোগিতা দরকার।সোনাইমুড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল কামাল জাগো নিউজকে জানান, বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে অনেক কাজ করে যাচ্ছেন। আর তাই সোনাইমুড়ীতেও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, ঝরে পড়া রোধকল্পে সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিড ডে মিল কার্যক্রম চালুর ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। এদিকে সোনাইমুড়ী উপজেলায় প্রাথমকি শিক্ষার মান উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার জন্য ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ড.রহিমা খাতুন চট্রগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।উপজেলা নির্বাহী অফিসার ড.রহিমা খাতুন জাগো নিউজকে জানান, সোনাইমুড়ী উপজেলায় শতভাগ শিক্ষার হার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক স্তর থেকে ঝরে পড়া ,পুষ্টিহীনতা রোধ করতে হবে। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আর এজন্য মিড ডে মিল চালুর গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে উপজেলার ১২১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৭টিতে এ কার্যক্রম চালু করেছেন। প্রতিদিন ১৭টি বিদ্যালয়ের ১৫শ শিক্ষার্থীকে খাবার দিতে খরচ হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। তার উদ্যোগের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ইতোমধ্যে অনেকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন। তবে এ কার্যক্রমের ধারাবিহকতা রাখার জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকল স্তুরের মানুষের কাছ থেকে মাসিক অনুদান নিয়ে শিক্ষা সঞ্চয় সহায়তা তহবলি গঠন করে আগামীতে সব কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানানা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল এটেনডেন্স সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাস চালুসহ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, জেলায় ৯টি উপজেলায় মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হলো ১২শ ১২টি। এর মধ্যে সোনাইমুড়ী উপজেলাতেই রয়েছে ১২১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সোনাইমুড়ী উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম চালু করলেও বতমানে ১৭টি প্রতিষ্ঠানে মিড ডে মিল কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। শুরুতে উপজেলার কম্পাউন্ডে রান্না করা খাবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরবরাহ করা হলে এখন স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়নে খাবার তৈরি করে তা শিক্ষাথীদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে।মিজানুর রহমান/এসএস/এমএস
Advertisement