করোনাভাইরাসের প্রভাবে মৌলভীবাজার জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। আতঙ্কের মধ্যে জীবন-যাপন করছে মানুষ। সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন শ্রমজীবীরা। সরকারিভাবে দুস্থ, অসহায় মানুষদের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ত্রাণসহায়তা দিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় ত্রাণ অপ্রতুল। আবার অনেক মধ্যবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্ত লজ্জায় বলতেও পারছেন না।
Advertisement
এমন সময় সারাদেশের মতো মৌলভীবাজারের মানুষেরও মন কাড়ছে পুলিশের কার্যক্রম। বাড়ি বাড়ি খাদ্য-সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। ত্রাণ বণ্টনে সহযোগিতা, কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসুস্থ রোগীদের হাসপতালে পৌঁছে দেওয়াসহ এমন কোনো সামাজিক কাজ নেই যা পুলিশ করছেন না। এসব কাজ করেই সাধারণের মন জয় করে নিয়েছেন মৌলভীবাজারের পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামান আশিক। তিনি শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার।
তার একটি বিশেষ উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছে। লকডাউন থাকায় নিম্ন মধ্যবিত্ততরা যে খাবারের সংকটে পড়েছেন এবং লোকলজ্জার ভয়ে বাইরে এসে সাহায্যও নিচ্ছে না তাদের জন্য তিনি আলাদা ব্যবস্থা নিয়েছেন।
গত কয়েকদিনে হাজারের ওপর এমন পরিবারের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন তিনি নীরবে। রাতের আঁধারে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে যান এবং তা বাড়ির সামনে বা দরজার সামনে রেখে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ফোনে জানিয়ে দেন। দূর থেকে দাঁড়িয়ে যখন দেখেন গ্রহিতা ত্রাণ নিয়েছেন তখন চলে আসেন। তার এমন কর্মকাণ্ডে মানুষের মনে পুলিশ নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল তা পাল্টাতে শুরু করেছে।
Advertisement
এ বিষয়ে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আশরাফুজ্জামান আশিক জাগো নিউজকে বলেন, সারাদিন বিভিন্ন কাজে আমরা ব্যস্ত থাকি। পূর্বের যেকোনো সময় থেকে এখন ব্যস্ততা বেড়েছে। আর রাতে আমার সময় চলে যায় কিছু মানুষের হাসি দেখে। লকডাউনের কারণে এমন কিছু মানুষ বিপদে পড়েছে যারা না খেয়ে থাকলেও সবার সামনে এসে চেয়ে নেবে না। যেমন বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক। হাজারও দোকান কর্মাচারী, ছোট ছোট ব্যবসায়ী। আমি তাদের জন্য খাবার বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করে তা আমার সরকারি গাড়িতে করে নিয়ে দরজায় দরজায় ছুটে চলি। চলমান সংকটে প্রায় ১৫শ পরিবারের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন জনের মাধ্যমে যখন জানতে পারি তারা অভাবে আছে তখন তা নোট করে রাখি। রাতে তাদের বাড়ির সামনে গিয়ে খাদ্য সামগ্রী রেখে একটু দূরে চলে এসে আড়াল থেকে ফোন দিই। যখন তিনি নিয়ে যান আমি চলে আসি। এই দূরে চলে আসার কারণ হচ্ছে, আমি যে দেখেছি এটা যেন ওই ব্যক্তি না বোঝেন। তার আত্মমর্যদায় যেন আঘাত না আসে। আমার চোখে চোখ পড়লে হয়তো লজ্জা পাবেন।
শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে যানা গেছে। লকডাউনের কারণে দিনে এ উপজেলাগুলোতে কিছু রিকশা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, টমটম ও ছোট গাড়ি চলাচল করলেও সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ শহরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের ছোট-বড় হাট বাজার। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কাউকেই ঘরের বাইরে বের হতে দিচ্ছে না প্রশাসন। যে কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন এই দুই উপজেলার খেটে খাওয়া, হতদরিদ্র মানুষেরা।
তাছাড়া এই ঘরবন্দি জীবন যত দীর্ঘ হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও শুরু হয়েছে টানাটানি। তাই এসব অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে নিত্যপণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আশরাফুজ্জামান।
Advertisement
এই দুই উপজেলার অন্তত ২০ জন মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে জাগো নিউজের কথা হলে তারা জানান, আমরা যোগাযোগ করি না। উনি (আশরাফুজ্জামান) বিভিন্নভাবে জানতে পারেন। উনি আমাদেরকে যে সহযোগিতা করেছেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। পুলিশ এত ভালো হতে পারে তা আমরা আগে ভাবিনি।
সহকারী পুলিশ সুপার আশরাফুজ্জামান আশিক বলেন, আমি রাতে খেয়ে দিব্বি ঘুমিয়ে পড়বো আর মানুষ না খেয়ে থাকবে, এটার নাম তো মানবতা না। দেশের এই দুঃসময়ে যদি মানুষের পাশে না দাঁড়াই তাহলে কোন সময় দাঁড়াবো। আমি সমাজের বিত্তবানদের কাছে বলতে চাই আপনারা মানুষের পাশে দাঁড়ান। যদি আপনার মনে হয় নিরাপত্তার জন্য বাইরে বের হবেন না, তাহলে আমাদের কাছে চাল ডাল আলু বা যা পারেন কিনে পাঠিয়ে দেন আমরা মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেব।
রিপন দে/এফএ/জেআইএম