মহামারি করোনায় আক্রান্ত পুরো বিশ্ব। এ থেকে বাঁচার জন্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যেখানে দিশাহারা। স্তব্ধ যেখানে বিশ্ব মানবতা। এমন মহাবিপদময় পরিস্থিতির মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক ব্যক্তির পা কেটে সেই পা হাতে নিয়ে গ্রামে আনন্দ মিছিল, অপরদিকে ফেনীতে ফেসবুক লাইভে এসে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা আমাদের আবারও ভাবিয়ে তুলেছে আমরা কতটা সভ্য। আমাদের বোধে আসে না এমন ভয়ংকর নৃশংসতা কীভাবে ঘটাতে পারে মানুষ। এসব ঘটনা আমাদের অজ্ঞতার যুগকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মানুষ এতটাই নৃশংস ও বর্বর হতে পারে? ধিক্কার জানানোর ভাষাও আমাদের জানা নেই। এসব বর্বর ঘটনা থেকে যা উপলব্ধি করছি তা হলো আমরা কি তাহলে অজ্ঞতার যুগে ফিরে যাচ্ছি?
Advertisement
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে এই যে একের পর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, এর কারণ যদি আমরা ক্ষতিয়ে দেখি তাহলে দেখা যায়, ঘটনার সূত্রপাত অতি তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমরা অন্ধকার যুগে ফিরে যাচ্ছি। যে জাহেলি যুগে তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুনাখুনি, হানাহানি এবং রক্তের বদলে রক্ত নিতে গিয়ে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের জীবনহানি ঘটত এবং বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধবিগ্রহ চলত। ঠিক তাই হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। দু-একটি সংঘর্ষের ঘটনার সূত্রপাত উল্লেখ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে আমরা কতটা অজ্ঞতার যুগে বাস করছি।
গত ৩১ মার্চ জেলার সরাইল উপজেলার পাকশিমুল ইউনিয়নের ভূইশ্বর গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত অর্ধশত মানুষ আহত হন। পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনে। পানি নিষ্কাশনের ড্রেন নির্মাণ নিয়ে ওইদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েক দফায় ভূইশ্বর গ্রামের বর্তমান ইউপি সদস্য মলাই মিয়া ও সাবেক ইউপি সদস্য নাসির উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। রাস্তার পাশে দলবেঁধে সংঘর্ষে অংশ নেন দুই পক্ষের কয়েকশ লোক।
গত ১ এপ্রিল লুডু খেলা নিয়ে আশুগঞ্জ উপজেলার বড়তল্লা গ্রামে ঘটে তুলকালাম কাণ্ড। কয়েকজন কিশোরকে স্মার্টফোনে লুডু খেলতে নিষেধ করলে তা নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে বাঁধে গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ। গ্রামের জামাল গোষ্ঠী ও রাব্বানী গোষ্ঠীর কয়েকশ লোক জড়িয়ে পড়েন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। এতে আহত হন অন্তত অর্ধশত মানুষ। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ে ওই সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনে।
Advertisement
নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের ফকিরদিয়া গ্রামে কিশোররা ক্রিকেট খেলতে চাইলে করোনাভাইরাসের কথা বলে স্থানীয় কয়েকজন তাদের বাধা দেন। এ নিয়ে কিশোরদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এর জেরে গত ১ এপ্রিল সকালে ফকিরদিয়া গ্রামের মুন্সিবাড়ির শাহ হোসেনের লোকজন ও সরকার বাড়ির আলমগীর মিয়ার লোকজন সংঘর্ষে জড়ান। দুই ঘণ্টা ধরে চলা ওই সংঘর্ষে নারীসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকটি ঘরবাড়িও ভাঙচুর করা হয়।
এরপর ৪ এপ্রিল সকালে জেলার কসবা উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে জমিতে মাটিকাটা নিয়ে দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তানভীর (২২) নামে এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন অন্তত ২০ জন। একই দিন মার্বেল খেলা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের ভাদুঘর দক্ষিণপাড়ায় শিশুদের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া হয়। শিশুরা সেই ঝগড়ার কথা বাড়িতে জানানোর পর সেটি রূপ নেয় গোষ্ঠীগত সংঘর্ষে। ওইদিন সন্ধ্যায় মোল্লাবাড়ি ও শেখবাড়ি গোষ্ঠীর লোকজনদের ওই সংঘর্ষে চোখ হারান মোজাহিদ নামে এক তরুণ। এ ঘটনায় আহত হন আরও ১৫ জন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
৫ এপ্রিল সরাইল উপজেলার পাকশিমুল ইউনিয়নের পরমানন্দপুর ও বড়উছড়া গ্রামের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় গান গাওয়ার জেরে ওই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ১২ এপ্রিল আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের থানাকান্দি গ্রামে দুই পক্ষের শত শত লোক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জড়িয়ে পড়েন সংঘর্ষে। সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষের এক সমর্থককের পা কেটে নিয়ে আনন্দ মিছিল করে আরেক পক্ষ। সেই মিছিল থেকে দেয়া হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ৩০ জন। এছাড়া উভয় পক্ষের বেশ কয়েকটি ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাই নয় বরং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক, পারিবারিক, আর্থিক লেনদেনসহ বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাড়ছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। গলাকেটে হত্যা করা, শ্বাসরোধে হত্যা, মারধরে হত্যা, যৌতুকের টাকা না পেয়ে হত্যা, জমি নিয়ে বিরোধ এবং হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার মতো লোমহর্ষক ঘটনাও ঘটছে। নিজের পরিবারের সদস্যরাই হয়ে উঠছে ঘাতক। নিজ সন্তানকেও হত্যা করতে হাত কাঁপছে না বাবা-মায়ের। অতি সামান্য ও তুচ্ছ কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটছে নৃশংস ও গা শিউরে ওঠার মতো সব হত্যাকাণ্ড।
Advertisement
আমরা জানি আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে আরবদের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। ইতিহাসের পাতায় আরবদের পঞ্চাশ বছর ও একশ বছর স্থায়ী যুদ্ধের কাহিনী ও বিবরণে পূর্ণ আর এসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল অতি তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে। দেখা যায় শাসনব্যবস্থা না থাকায় সে সময় গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব-কলহ এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। গোত্রের মান-সম্ভ্রম ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সদস্যগণ জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিত। এ গোত্র-কলহ ও বিসংবাদ কখনো বংশানুক্রমিকভাবে চলত। ‘খুনের বদলে খুন’ এ ধারায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ত বছরের পর বছর।
ঐতিহাসিক গিবনের মতে, অন্ধকার যুগে আরবে গোত্রীয় দ্বন্দ্বের কারণে ১৭০০ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। বুয়াসের যুদ্ধ, ফিজারের যুদ্ধ, বসুসের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে ছিল উল্লেযোগ্য। উটকে পানি খাওয়ানোর সামান্য ঘটনা কেন্দ্র করে বনু বকর ও বনু তগলিব গোত্রের মধ্যে সুদীর্ঘ ৪০ বছরব্যাপী যুদ্ধ চলে ছিল। অতি তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে তাদের মাঝে যুদ্ধ চলত বছরের পর বছর। ঠিক একই ধরনের দৃশ্য আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাগুলো থেকে পেয়ে থাকি।
আধিপত্য বিস্তার ও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংঘর্ষে জড়ানো রীতিমতো ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। পান থেকে চুন খসে পড়লেই দা, লাঠি, টেঁটা, ফলা ও বল্লমের মতো দেশীয় মারণাস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষ। যুগ যুগ ধরে চলা এসব গ্রাম্য সংঘর্ষে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। আবার আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন অনেকে।
আজ আমরা এতটাই বর্বর হয়ে গেছি যে, মানুষকে মানুষ বলেই মনে করছি না। যখন যা ইচ্ছে তাই করছি। অথচ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু এই মানুষই আবার কর্মের কারণে বর্তমান সময়ে সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব বলে পরিগণিত হচ্ছে। যে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ থাকে না, তাকে মানুষ বলা যায় না। মানুষ বলতে মানুষের ভেতর মানবীয় গুণ থাকতে হয়।
ভুপেন হাজারিকার সেই অমর গানের দু’টো লাইন খুব মনে পড়ছে, ‘মানুষ যদি সে না হয় মানুষ/দানব কখনো হয় না মানুষ।’ ঠিক তাই। হাত, পা, মাথা, চোখ, নাক, কান থাকলেই সবাই মানুষ হয় না। শুধু মনুষ্যকুলে জন্ম নিলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে মানবিকগুণ, নৈতিকতা, সহিষ্ণুতা থাকতে হয়।
পারিবারিক মায়া-মমতার বন্ধনও যেন কমতে শুরু করেছে। করোনা আক্রান্ত মমতাময়ী এক মাকে যখন আদরের সন্তানরা শালবনে ফেলে রেখে চলে যায় তখন মানুষ হিসেবে নিজেকে ভাবতে বড় কষ্ট হয়। হায় মানবতা। মানুষ মানুষের জন্য হৃদয়ের টান আজ আর অনুভব করে না। নেই কারও প্রতি কারও মায়া-মমতা ও ভালোবাসা।
শেষে এটাই বলব, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এসব সংঘর্ষ কখনই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের কর্ম হতে পারে না। তাই আসুন, প্রকৃত মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য কাজ করি। সেই সাথে সমাজ ও দেশের শান্তিশৃঙ্খলায় যারা বিঘ্ন ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং এসব নৃশংসতার বিরুদ্ধে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
এইচআর/বিএ/এমএস