মার্কিন বুদ্ধিজীবী ও লেখক নোয়াম চমস্কি করোনাভাইরাস ইস্যুতে বাজার অর্থনীতির সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ১৫ বছর আগের সার্স ধরন পাল্টে করোনাভাইরাস মহামারিতে রূপ নেবে, এটা খুব ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল। বিশ্বজুড়ে ল্যাবগুলো তখনই করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় কাজ করতে পারত। কেন করেনি? বাজার ভুল ইঙ্গিত দিয়েছিল। বিশেষ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো। আমরা আমাদের ভাগ্য স্বৈরশাসকের মতো করপোরেশন নামক প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর হাতে দিয়ে রেখেছি’। চমস্কি এটাও বলেছেন যে, আমেরিকার মতো দেশে যখন ভেন্টিলেটরের সংকট দেখা দেয় তখন নব্য উদারনৈতিক পুঁজিবাদের নিষ্ঠুর চেহারা আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়।
Advertisement
নিষ্ঠুরতা এ জন্য যে, ইউরোপ-আমেরিকায় পুঁজিবাদই চিকিৎসকদের বাধ্য করছে বৈষম্য করতে, সিদ্ধান্ত নিতে কাকে তারা আইসিইউ বা ভেন্টিলেটর দেবেন বা দেবেন না। বাংলাদেশে চিকিৎসা করতে গিয়ে একজন নাগরিককে নিজের পকেট থেকে ব্যয় করছে ৬৭ শতাংশ অর্থ। আমাদের ধারণা ছিল, দরিদ্র দেশ হিসেবে এটাই বোধহয় নিয়তি। কিন্তু এখন বাজার অর্থনীতির স্বর্গ আমেরিকা থেকে যেসব খবর আসছে সেগুলোও বেশ উপভোগ্য। সেখানকার পরিষ্কার কথা অর্থ আর স্বাস্থ্যবীমা থাকলে তবেই চিকিৎসা হবে, অন্যথায় নয়। সরকার শুধু কোভিড-১৯ এর পরীক্ষাটা করে দেবে, চিকিৎসা নয়। বাস্তবতা হলো আমেরিকার তিন কোটি মানুষের স্বাস্থ্যবীমা সুবিধাই নেই।
তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াল? পুঁজিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, সবকিছু বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও পরাক্রমশালী অর্থনীতি আমেরিকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন করুণ হাল? লক্ষ লক্ষ আক্রান্ত আর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তবে কি আজ নতুন বোধোদয় যে, বাজার ব্যর্থ হয়েছে? আমেরিকা তার পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে সারাবিশ্বের কোথাও না কোথাও সবসময় যুদ্ধে লিপ্ত থাকে বড়, মাঝারি, ছোট সব দেশকেই তার অস্ত্রের বাজার বানিয়ে রেখেছে। যে আমেরিকা সব দেশের সব সমস্যায় ভূমিকা রাখে সে নিজেই আজ নিজেকে সামলাতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রে সাত লাখ লোক আক্রান্ত আর মারা গেছে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ। ২০০০ সালে যেখানে আমেরিকার মোট অস্ত্র রফতানি ছিল ৭৫০০ মিলিয়ন ডলার, ২০১৮ সালে তা হয়ে যায় ১২০৫০ মিলিয়ন ডলার।
এই যুদ্ধ অর্থনীতি মূলত বাজারব্যবস্থার মোড়কে পরিচালিত হয়ে আসছে। এখন খোদ মার্কিন আর ইউরোপীয় নাগরিকরা জরুরি ভেন্টিলেটরের অভাবে পর্যদুস্ত অবস্থায় পড়েছে। এ কারণে অনেকে বলছে, কোভিড-১৯ এ বহু মানুষ মরছে, আরও মরবে, কত প্রতিষ্ঠান, কত ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, তবে মৃতের তালিকায় এক নম্বরে থাকবে মুক্তবাজার কাঠামো। কারণ এই অর্থনীতি অপ্রতিরোধ্য গতিতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি করেছে, মানুষে মানুষে অসাম্য বাড়িয়েছে, সমাজে সমাজে বিদ্বেষকে উস্কে দিয়েছে।
Advertisement
রাজনৈতিকভাবে প্রয়োগ করা শক্তিশালী বাজার অর্থনীতি, যাকে আবার বলা হয় নিও-লিবারালিজম, তার রুগ্ন চেহারাটা বুঝতে শুরু করেছে কোভিড-১৯ এর আগমনের সাথে সাথে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন নব্য উদারতাবাদের এই মডেল গত তিন দশকে শুধু লাগাম ছাড়া মুনাফাই খুঁজেছে, মনে করেছে অর্থ থাকলেই চিকিৎসাসহ সবকিছু হাতের নাগালে চলে আসবে। মুনাফার থাবা এমই যে, এমন এক বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যায়ও পুঁজির দাপটে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের করপোরেট হাসপাতালগুলো হাত গুটিয়ে বসে আছে। করোনা ছাড়া অন্য রোগে আক্রান্তরাও এখন চিকিৎসা পেতে অসুবিধায় পড়ছে।
যেকোনো মহামারিতে অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়। কিন্তু শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো যখন এমন অসহায় অবস্থায় পড়েছে তাতে প্রশ্ন উঠেছে পৃথিবী আর কতকাল লাভের বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করবে। এই তিন দশকে বাজার অর্থনীতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এ ছাড়া উন্নয়নের আর কোনো পথ নেই। ধর্মীয় মৌলবাদের মতো দর্শনে পরিণত করা হয়েছে এই ব্যবস্থা।
লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে বলেছে, অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা বাড়াতে হবে, সবকিছু বেসরকারিকরণ করলে চলে না। “Radical reforms- reversing the prevailing policy direction of the last four decades- will need to be put on the table. Governments will have to accept a more active role in the economy. They must see public services as investments rather than liabilities, and look for ways to make labour markets less insecure. Redistribution will again be on the agenda; the privileges of the elderly and wealthy in question. Policies until recently considered eccentric, such as basic income and wealth taxes, will have to be in the mix.”
পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র আবার ফিরবে সে কথা কেউ বলছে না। তবে এই করোনাকালে চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম প্রমাণ করল অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য সার্বজনীন, স্বাস্থ্য নাগরিকের মৌলিক অধিকার। জনস্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ধনী দেশের চেয়েও যে এগিয়ে আছে কিউবা সেটিও বিশ্ববাসী দেখল। নব্য উদারতাবাদের নামে চলতে থাকা বাজারব্যবস্থার জয়গান হয়তো আর গাইবে না মানুষ।
Advertisement
এইচআর/বিএ/এমএস