ছোটবেলায় মায়ের মুখে অসংখ্যবার শুনেছি, ‘বনের বাঘ নয়, মনের বাঘই মানুষকে খায়’। তিনি বলতেন, বনের বাঘ আঘাত করার আগে মানুষ টের পায় বা প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু মনের বাঘ যদি মানুষকে খেতে শুরু করে তাহলে সে টের পায় না। সে মানুষ দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। যেকোনো বিপদ-আপদে মনকে শক্ত করার কথা বলতেন তিনি। এমন অনেক ঘটনায় আমার মা সাহসী হওয়ার মন্ত্র জপতেন কানের কাছে। এখনো বলেন, মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে তার বিশ্বাস, সাহস ও ধৈর্য।
Advertisement
বিশ্বাস, ধৈর্য ও সাহস প্রসঙ্গে প্রায় সব ধর্মেই নানা নির্দেশ ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা নির্ধারিত প্রেরিত পুরুষরাও এ বিষয়ে বারবার মানুষকে বলেছেন। এখানে শেখ সাদী খান রচিত কয়েকটি পঙক্তির বাংলা অর্থ পাঠকদের জন্য তুলে ধরতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার বাবার এক বন্ধুর টেবিলে বাঁধানো অবস্থায় পড়েছিলাম- ‘ধৈর্য বিষের মতো আগে মনে হয়/পরে কিন্তু তার ফল বেশ মধুময়/রাজার চেয়ে সুখী কত দীন-দুঃখীজন/সন্তোষ সুধায় ভরা যাহাদের মন’। পরবর্তীতে সমস্যা-সংকট বা বিপদকালে শেখ সাদী খানের এ ধৈর্যবাণী আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। এখনো আমি এ বাণীগুলো আওড়াই।
বড়বেলায় দেখা একটি হিন্দি ছবির কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। ‘বাস্তব’ নামের ছবিটিতে মহাপরাক্রমশালী ডন সঞ্জয় দত্তকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে তার মা। বহু মানুষকে খুন করা সঞ্জয় জীবনের একটা পর্যায়ে এসে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় প্রতিদিনই ঘরের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে পালিয়ে সে জীবন রক্ষার চেষ্টা করত। প্রাণভয়ে ভীত সঞ্জয় দত্ত একসময় এতটাই ভেঙে পড়েন যে, তার মনে হতে থাকে যেকোনো সময় তার প্রাণপ্রদীপ নিভে যাবে। অসীম সাহসী ছেলের এই রূপ মাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলে। মা তার সন্তানকে ভয় থেকে মুক্তি দিতে খুন করে।
করোনা আতঙ্ক ও সন্দেহে আক্রান্ত দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এসব প্রসঙ্গের অবতারণার উদ্দেশ্য হলো তারা যাতে মনের শক্তি বৃদ্ধি এবং ধৈর্যধারণ করেন সৃষ্টিকর্তার সাহায্যের আশায়। আমরা সবাই জানি, করোনা থেকে বাঁচতে হলে সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের কথা। ভাইরাসটি প্রতিরোধ করার কোনো কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কার হয়নি। এছাড়া আমরা যখন দেখি বিশ্বের উন্নত দেশগুলো প্রতিনিয়ত কাবু হয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাসে তখন আতঙ্কগ্রস্ত হই। যখন দেখি বাংলাদেশে টেস্টের পরিমাণ যত বাড়ছে ততই ভাইরাস আক্রান্তের পরিমাণ বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে, তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ি স্বাভাবিকভাবে। অথবা যখন শুনি সংস্পর্শ থেকে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়ায় তখন মনে সন্দেহ দানাবাঁধে।
Advertisement
কিন্তু এভাবে আতঙ্ক ও মন দুর্বল করা সন্দেহকে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা নিজেদের ভেতরে থাকা সুরক্ষাশক্তি বিনষ্ট করছি কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। আমরা জানি, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অন্তর্গত কিছু ক্ষমতা মানুষ সৃষ্টিকর্তার দয়ায় পাই। সেই ক্ষমতার ধার কমিয়ে দেয় আতঙ্ক ও হতাশা। সুতরাং আমাদের সতর্ক ও সচেতন থেকে ধৈর্যধারণ করে সংকট মোকাবিলা করতে হবে। খাদ্য ও জীবনাচারের মাধ্যমে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে মনকে সন্দেহমুক্ত রেখে জীবন পরিচালনা করলে সমস্যা অনেক কমে আসবে।
করোনা আক্রান্ত হলে কোনো না কোনোভাবে শরীর সেটা জানান দেবে। কিন্তু আক্রান্ত না হয়েও যদি সবসময় সন্দেহে ভুগতে থাকি তাহলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমাদের কাজ হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশীয় চিকিৎসকরা যে নির্দেশনা দেন, তা মেনে চলা। বাকিটুকু ছেড়ে দেই না কেন সৃষ্টিকর্তার ওপর। কারণ তিনিই তো জানেন আমাদের জন্য ভালো কোনটি।
মহামতি সক্রেটিসের একটি বাণীর তুলে ধরতে চাই। তিনি হেমলক পানকালে বলছিলেন- আই টু ডাই, অ্যান্ড ইউ টু লিভ, হুইচ ইজ বেটার? ওনলি গড নোজ’। অর্থাৎ আমি মরতে যাচ্ছি, তোমরা বেঁচে থাকবে। কোনটি ভালো? সেটা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
লেখকবিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক যায়যায়দিনসাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)
Advertisement
এইচআর/বিএ/পিআর