মতামত

মানুষ মানুষের জন্য

এটি এমন একটি সময় যখন মানুষজন করোনাভাইরাস ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা বলছে না। এর মাঝেই পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ ঘরের ভেতর স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে থেকেছে। এখন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন ঘর থেকে বের হয়ে আবার আগের জীবনে ফিরে যাবে। কতখানি আগের জীবনে ফিরে যেতে পারবে, সেটা নিয়েও অনেকের ভেতর সন্দেহ। ঘর থেকে বের হলেও হয়তো মুখে মাস্ক লাগিয়ে বের হতে হবে, একজন থেকে আরেকজনকে সবসময় দূরে দূরে থাকতে হবে, শুধু তাই নয়, কে জানে হ্যান্ডশেক জাতীয় বিষয়গুলো পৃথিবী থেকেই উঠে যাবে কি না! সেগুলো হচ্ছে ভবিষ্যতের ব্যাপার, আপাতত আমরা অপেক্ষা করছি কখন এই ভয়াবহ দুর্যোগটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে আসে।

Advertisement

অমর্ত্য সেন এটাকে যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। যারা যুদ্ধ দেখেছে তারা জানে সেটি কী ভয়ানক একটি ব্যাপার। যখন যুদ্ধ চলতে থাকে তখন সেটি এক ধরনের বিপর্যয়, যখন যুদ্ধ শেষ হয় তখন সেটি অন্য এক ধরনের বিপর্যয়। মনে হতে পারে এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ বুঝি ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস! আসলে সেই ভাইরাসটি প্রতিপক্ষ নয়, এই ভাইরাসটি যতক্ষণ শরীরের বাইরে থাকে ততক্ষণ একটি জড় পদার্থ ছাড়া কিছু না। কোনোভাবে মানুষের শরীরে ঢুকতে পারলে সেটি তার জীবন ফিরে পায়। যে প্রক্রিয়ায় একটি ভাইরাস মানুষের শরীরে তার বংশ বৃদ্ধি করে তার চাইতে বিস্ময়কর বিষয় আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু তার আয়ু দুই সপ্তাহের মতো, এর মাঝেই বেশিরভাগ মানুষ শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে ভাইরাসটিকে পরাস্ত করে ফেলে। বয়স্ক, রুগ্ন, দুর্বল, রোগাক্রান্ত কিংবা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের কেউ কেউ মারা যান। (সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম থাকে, এই নিয়মেরও ব্যতিক্রম আছে তাই মাঝে মাঝে আমরা দেখি কমবয়সী সুস্থ সবল যুবারাও মারা যাচ্ছেন।) শতাংশের হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যাটি হয়তো খুব বেশি নয় কিন্তু ভাইরাসের সংক্রমণটি এত ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে যে, এত অসংখ্য মানুষ এত তাড়াতাড়ি আক্রান্ত হয়ে যায় যে, হঠাৎ করে দেখা যায় যারা বাড়াবাড়ি অসুস্থ তাদেরও চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না। তাই প্রাণপণ চেষ্টা করা হয় মানুষকে আলাদা আলাদা রাখতে যেন সংক্রমণটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে থাকে। হঠাৎ করে একসাথে যেন অসংখ্য মানুষকে চিকিৎসা করার প্রয়োজন না হয়।

এটি যদি যুদ্ধ হয়ে থাকে এবং সেই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ যদি ভাইরাসটি না হয়ে থাকে তাহলে প্রতিপক্ষটি কে? আমরা এখন সবাই জানি প্রতিপক্ষ হচ্ছে থমকে যাওয়া পৃথিবীতে আশ্রয়হীন, সহায়-সম্বলহীন, দিন আনে দিন খায় মানুষের অনিশ্চিত জীবন। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে যতদিন থমকে যাওয়া দেশ আবার সচল না হচ্ছে ততদিন এই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে সচল রাখা, তাদেরকে মানুষের সম্মান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা। এবারের যুদ্ধ হচ্ছে কর্মহীন, অসহায় দরিদ্র মানুষ রক্ষা করার যুদ্ধ, যাদের জন্য ‘সামাজিক দূরত্ব’ নামের কথাটিই একটি বিলাসিতা।

গণিতের হিসেবে যতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত না হচ্ছে ততদিন একজন মানুষ আরেকজনকে আক্রান্ত করে যাবে। যদি সেটা হয় নিয়ন্ত্রণের মাঝে, খুব ধীরে ধীরে তাহলে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। (প্রতি বছর সাধারণ ফ্লুতে সারা পৃথিবীতে তিন থেকে ছয় লক্ষ মানুষ মারা যায়,আমরা সেটা নিয়ে কখনো বিচলিত হই না) করোনাভাইরাসের সংক্রমণটাকে ঠিকভাবে থামানোর জন্য দরকার একটা প্রতিষেধক বা টিকা। সেটা নিশ্চয়ই চলে আসবে কিন্তু তার জন্য বছরখানেক সময় দরকার। পৃথিবীর সব মানুষকে এই টিকা দেয়াটাও একটা বিশাল দজ্ঞ-যজ্ঞ ব্যাপার। কাজেই আমরা সবাই আশা করছি, সবাই মিলে সামনের দিনগুলোর জন্য খুব চিন্তাভাবনা করে একটা পরিকল্পনা করছেন যেন দেশের মানুষ এই বিপর্যয়ের মাঝে টিকে থাকতে পারে। ঘরবন্দি হয়ে থাকার কারণে যারা সেলুনে গিয়ে চুল কাটতে পারছেন না কিংবা নেটফ্লিক্সে দেখার মতো ভালো ছবি না পেয়ে যাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন আনন্দময় করা এই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ নয়।

Advertisement

যে মা তার ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে খাবার দিতে পারছে না, সেই মায়ের পাশে খাবারের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়ানো হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। সেদিন খবরে এসেছে সিরাজগঞ্জের দশ বছরের একটি শিশু তার বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আফরোজা নামের সেই শিশুটি অভিমান করেছে ক্ষুধার্ত হয়ে, সময়টি খারাপ তাই তিন বেলার বদলে দুবেলা খেতে পাচ্ছে সেই কারণে তার অভিমান। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসের কারণে লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে। এইসব মৃত্যু হয়তো মেনে নেয়া যাবে কিন্তু ভাইরাসের সরাসরি সংক্রমণ না হয়েও দশ বছরের এই অভিমানী শিশুটির মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যাবে না। অমর্ত্য সেন যে যুদ্ধের কথা বলেছেন এই যুদ্ধ হচ্ছে এই লক্ষ লক্ষ অভিমানী শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ।

২.

একটি দুঃসময়ে মানুষের ভেতরের ভালো দিকটি যে রকম বের হয়ে আসে খারাপ দিকটিও একইভাবে বের হয়ে আসে। সংবাদ মাধ্যমে ভালো খবরগুলো যতটুকু প্রকাশ করে খারাপ খবরগুলো তার থেকে বেশি প্রকাশ করে কি না জানি না কিন্তু মনে হচ্ছে করোনাভাইরাসের দুর্যোগের এই সময়টিতে খারাপ খারাপ খবরগুলো একটু বেশি দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ত্রাণের চাল চুরির অভিযোগ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এই দুর্যোগের সময় যে মানুষ চাল চুরি করতে পারে তাদেরকে আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারি না, সত্যি কথা বলতে কী বুঝতে চাইও না। মানুষগুলো কেমন করে তাদের স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের সামনে মুখ দেখায়? শুধু যে চুরি-চামারি তা নয়, হৃদয়হীন ঘটনারও কোনো শেষ নেই। বৃহত্তর সিলেটের কোনো এক জায়গায় একজন শ্রমিক মারা গেছে, মানুষটির মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসের কারণে এই ধরনের একটা ভাসা ভাসা ধারণার কারণে তাকে কবর দিতে নেয়ার জন্য গ্রামের মসজিদের খাটিয়াটি পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেয়া হলো না। মানুষটির বৃদ্ধ বাবা এবং দুই ভাই মিলে মৃতদেহটি বহন করে নিয়ে গেল কবর দিতে। সংবাদ মাধ্যমে সেই ছবিটির চাইতে হৃদয়হীন ছবি আর কী হতে পারে? তবে সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়েছে শেরপুর নালিতাবাড়ীর একটি ঘটনা। মা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে সন্দেহ করে ছেলেমেয়েরা মিলে শেয়াল কুকুরে খেয়ে ফেলার জন্য তাদের মাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেল। খবরটি পড়েও বিশ্বাস হতে চায় না, সত্যিই কি এটি ঘটেছে? এ রকম ঘটনা সত্যিই ঘটা সম্ভব? করোনাভাইরাস থেকে সতর্ক থাকার একটি ব্যাপার আছে, কিন্তু সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে হবে সেটি কে বলেছে?

৩.

Advertisement

শুধু খারাপ ঘটনাগুলোর কথা বলা হলে মানুষের মনুষ্যত্ব নিয়ে একটা ভুল ধারণা হয়ে যাবে। এ রকম সময়ে অসংখ্য মানুষ একে অপরকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসছে সেটিও তো সত্যি। আমি আমার পরিচিত অনেক মানুষকে দেখেছি তারা নিজের মতো করে কর্মহীন মানুষদের সাহায্য করে যাচ্ছে। ছবি তুলে সেগুলো সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো হয় না কিংবা ফেসবুকে প্রচার করা হয় না তাই আমরা সেগুলোর কথা জানি না। আমরা আমাদের দেশের ইতিহাসে দেখেছি, বড় বড় দুর্যোগের সময় রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনগুলো সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে, এবারেও সেগুলো ঘটতে শুরু করেছে। বরিশালে বাসদের উদ্যোগে অ্যাম্বুলেন্স সেবা এবং সততা বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে বলে দেখেছি। এবারের নববর্ষে কোনো আনন্দোৎসব নেই বলে পিরোজপুরে একজন ঘরে ঘরে গিয়ে শিশুদের হাতে খেলনা তুলে দিচ্ছেন। নববর্ষের অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা করে রাখা টাকা অনেক প্রতিষ্ঠানই নিম্নবিত্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য তুলে দিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তির ছেলেমেয়েদের অনেকেই করোনা আক্রান্ত মানুষদের খুঁজে বের করার অ্যাপ তৈরি করেছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপযুক্ত ল্যাবরেটরি আছে তারা করোনা আক্রান্তদের পরীক্ষা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র রক্ত পরীক্ষা করে অ্যান্টিবডি থেকে খুবই সাশ্রয়ী উপায়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিহ্নিত করার পদ্ধতি বের করেছে। সরকারের সহযোগিতায় এই কিটগুলো তৈরির প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট দেশে নিয়ে আসা হয়েছে। বসুন্ধরা তাদের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটিতে করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী বিশাল একটি হাসপাতাল তৈরি করতে যাচ্ছে, সবকিছু ঠিক থাকলে এই মাসের ২০ তারিখের পরে ওই হাসপাতালে ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা শুরু হবে।

শুধু বড় বড় প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যাক্তিগতভাবেও অনেক বড় কাজ হচ্ছে। আমাদের দেশের একজন ডাক্তার জোবায়ের চিশতী কয়েক বছর আগে শিশুদের নিউমোনিয়া রোগের চিকিৎসায় সাহায্য করার জন্য শ্যাম্পুর বোতল ব্যবহার করে হাজার খানেক টাকা দিয়ে ভেন্টিলেটর জাতীয় একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন যেটি বিশ্ব স্বাস্থ্য কেন্দ্র শিশুদের নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করার জন্য অনুমোদন দিয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য কেন্দ্র ইতোমধ্যে এই যন্ত্রটি শিশুদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট হলে ব্যবহারের জন্যে সুপারিশ করছে। ডা. জোবায়ের চিশতী এই যন্ত্রটি বড়দের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায় কিনা তার ওপর কাজ করে যাচ্ছেন। আশা করে আছি দ্রুত কিছু একটা সাফল্য আমরা দেখতে পাব। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাইক্রোপ্রসেসর প্রস্তুতকারক কোম্পানি হচ্ছে ইন্টেল, তার বোর্ডের চেয়ারম্যান হচ্ছেন আমাদের বাংলাদেশের ওমর ইশরাক। তার চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক কোম্পানির নাম মেডট্রনিক, সেই কোম্পানির ভেন্টিলেটরের প্রযুক্তিগত সকল তথ্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে, যেন কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়াই যে কেউ এই প্রয়োজনীয় যন্ত্রটি তৈরি করতে পারে। এ রকম উদাহরণ নিশ্চয়ই আরও অনেক আছে, যেগুলো আমার চোখে পড়েনি কিংবা এই মুহুর্তে আমি জানি না।

যুদ্ধের সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাধারণ মানুষের মনোবল। করোনাভাইরাসের এই বিপর্যয়টি সামলে নেয়ার বিষয়টি যদি সত্যি একটি যুদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে এবারও আমাদের মনোবল রক্ষা করতে হবে। দেশের পুরো মানবসম্পদ যদি সাহস নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে নিশ্চয়ই এবারও আমরা এই কঠিন সময়টি পার করতে পারব।

মানুষ মানুষের জন্য- এর চাইতে বড় সত্যি কথা আর কী আছে?

এইচআর/বিএ