ঠিক এক মাস আগে অর্থাৎ গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বীর সতর্কবার্তা উদ্ধৃত করে ‘এই মুহূর্তে করোনার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে জাগো নিউজ। নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, আজ ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কথাগুলো সত্য হতে যাচ্ছে।
Advertisement
মহামারিতে রূপ নেয়া করোনাভাইরাস আজ শহর-গ্রামের ফারাক মানছে না। নারী-পুরুষ কিংবা শিশু, যুবক-বৃদ্ধ; উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত— কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে করোনা যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া চিকিৎসক ও পুলিশ সদস্যরাও সংক্রমিত। সর্বশেষ করোনার থাবা পড়েছে দেশের অর্থনীতির হৃদস্পন্দন চট্টগ্রাম বন্দরে।
বুধবার (১৫ এপ্রিল) রাতের আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের পাঁচ বাসিন্দাসহ মোট ছয়জনের শরীরে করোনার সংক্রমণের তথ্য দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। তাদের মধ্যে দুজন পুলিশ সদস্য, একজন চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচারী। এছাড়া এক নারীর মৃত্যুর পর তার করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে। তিনিও নগরের বন্দর থানার নিমতলার বাসিন্দা।
গত ১২ এপ্রিল নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের একটি ব্যারাকে নগর ট্রাফিক (উত্তর) বিভাগের এক পুলিশ কনস্টেবল প্রথমবারের মতো করোনায় আক্রান্ত হন। শনাক্ত দুই পুলিশ কনস্টেবল ওই ব্যারাকে প্রথম রোগীর সংস্পর্শে ছিলেন। এ ঘটনায় ২০০ পুলিশ সদস্য এবং তিন চিকিৎসকসহ ২২৫ জনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।
Advertisement
এদিকে পুলিশ লাইন্সের মতো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও জনসমাগমস্থলে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় প্রভাব পড়েছে বাকি পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও। কেউ কেউ বলছেন, দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর যেখানে একটু শান্তির নিশ্বাস নিতাম সেটাও আর নিরাপদ রইল না।
একইভাবে চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকায় শনাক্ত হওয়া করোনা রোগী চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করতেন বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জোবায়ের। এছাড়া মারা যাওয়ার পর মমতাজ বেগম নামে এক নারীর দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। মমতাজ বেগম গত ১৩ এপ্রিল মারা যান। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি)’র একজন সহকারী সার্জন তার নমুনা সংগ্রহ করেন। করোনায় মারা যাওয়া ওই নারীর বাড়িও বন্দর থানার নিমতলা এলাকায়।
এক মাস আগে সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বী মিয়া বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলা এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে। কারণ আমাদের দুটি বন্দর, একটি বিমানবন্দর ও অপরটি সমুদ্রবন্দর। দুটি বন্দর দিয়ে সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এন্ট্রি পয়েন্টেই যদি সংক্রমণকারীকে ঠেকিয়ে দেয়া না যায়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।’
ওই সময় ইতালিফেরত প্রবাসীদের কারণে চট্টগ্রামে ঝুঁকির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে বলে জানানো হয়। ঠিক এক মাস পর রূঢ় বাস্তবতা এখন দৃশ্যমান। চট্টগ্রামের মানুষ নিজেরাই নিজেদের শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
Advertisement
লকডাউন সত্ত্বেও ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামে ফেরা মানুষের ঢল যেমন বন্ধ করা যায়নি, তেমনি বন্ধ করা যায়নি নগরের অলিগলি থেকে রাজপথ, বাজার থেকে ফুটপাতে অযথা ঘুরোঘুরি। তাই যা হওয়ার হয়েছে, চট্টগ্রাম আজ করোনার হটস্পট।
নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপ-কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল ওয়ারিশ এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে প্রথম করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে ছিলেন দুই ট্রাফিক কনস্টেবল। পরে তারাও আক্রান্ত হন। তাদের একজনের বয়স ২৫, অপরজনের ২৬ বছর। নতুন আক্রান্ত ওই দুই পুলিশ সদস্য আগের আক্রান্তের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাই তারাও কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। এখন তাদের আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশনে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে। গত ১২ এপ্রিল ট্রাফিক পুলিশের যে সদস্য করোনায় আক্রান্ত হন তিনিও জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তিনি আরও বলেন, আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের বিদেশ-গমন কিংবা বিদেশ-ফেরত কারও সংস্পর্শে যাওয়ার ইতিহাস নেই। তাই আশঙ্কা করছি নগরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তারা সামাজিক সংক্রমণের শিকার হয়েছেন।
এদিকে তিনদিনের ব্যবধানে তিন পুলিশ সদস্যের মাঝে করোনা শনাক্ত হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন্সে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, দিন-রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর যেখানে একটু শান্তির নিশ্বাস নিতাম সেটাও আর নিরাপদ রইল না।
তিন সদস্য আক্রান্তের পর নগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান নগরীতে দায়িত্বরত চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সব সদস্যকে আরও সতর্ক হয়ে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে পুলিশ লাইন্সের ট্রাফিক বিভাগের ওই ব্যারাক লকডাউন করা হয়েছে।
এদিকে নগরীর আনোয়ারায় যে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচারী এবং করোনা শনাক্তের কয়েকদিন আগে তিনি বন্দরে কাজ করেছেন বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জোবায়ের। এমন খবরে চট্টগ্রাম বন্দরে করোনা ছড়িয়ে পরার শঙ্কা দেখছেন বন্দর-সংশ্লিষ্টরা। ঘটনার পরই জরুরি বৈঠক ডেকেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার ক্যাপ্টেন তানভির হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনা সতর্কতায় আমরা শুরু থেকেই সচেতনভাবে কাজ করছি। কিন্তু বন্দরের এক কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে কিছুটা অস্বস্তিতে আছি।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (অ্যাডমিন অ্যান্ড প্ল্যানিং) মো. জাফর আলম বলেন, ‘ওই ব্যক্তি কীভাবে করোনায় আক্রান্ত হলেন, সে বিষয়টি প্রথমে শনাক্তের চেষ্টা হচ্ছে। কারণ প্রায় এক মাস আগে থেকে বন্দরের প্রতিটি গেটে হাত ধোয়ার জন্য সাবান ও পানি সরবারহ করেছি আমরা। শ্রমিক বা গাড়ির চালক, যারাই বন্দরের অভ্যন্তরে জেটিতে প্রবেশ করবেন তাদের বেশি সময় সেখানে অবস্থান করতে দেয়া হচ্ছে না। বন্দরে করোনাভাইরাস ঠেকাতে দুদিক থেকে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। বাইরে থেকে যেন ভাইরাসটি বন্দরে প্রবেশ করতে না পারে আবার সমুদ্রপথে প্রবেশ ঠেকাতেও আমরা তৎপর।’
‘এক মাস আগে থেকেই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশের পর দেশি-বিদেশি সব জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বেতার নিয়ন্ত্রণ যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের নাবিকদের শারীরিক অবস্থা জানানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে। তারা সেটি দিচ্ছেনও। এরপর বন্দরের বহির্নোঙরে আসার পর সরকারি মেডিকেল টিম গিয়ে নাবিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন।’
এদিকে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশ থেকে আসা পণ্যবাহী জাহাজের নাবিকদের স্ক্রিনিং ফের সঠিকভাবে করার নির্দেশনা দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির। সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর জেটি ও বহির্নোঙরে আসা দেশি-বিদেশি জাহাজের নাবিকদের স্ক্রিনিং সঠিকভাবে করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ এপ্রিল নতুন এ নির্দেশনা দেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক ও জনবল দেয়া হয়েছে। তারপরও জেটি ও বহির্নোঙরে আসা দেশি-বিদেশি জাহাজের নাবিকদের স্ক্রিনিং সঠিকভাবে করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় জাহাজের নিয়মিত পরিদর্শন জোরদারের জন্য নির্দেশনা দেয়া হলো।’
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীন থেকে আসা যেকোনো পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন পূর্ণ করা হচ্ছে। চীনের বন্দর থেকে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে ১২/১৩ দিন লাগে। আরও দুদিন অপেক্ষার পর বন্দরের স্বাস্থ্যকর্মীরা বহির্নোঙরে গিয়ে জাহাজে থাকা নাবিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। তাদের দেয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে ওই জাহাজ-কে জেটিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু নামমাত্র পরিদর্শন অথবা জাহাজে না গিয়ে সনদে সই করার অভিযোগ ওঠে। ফলে বিদেশি নাবিকদের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে- বলেন তারা।
তবে বন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোতাহার হোসেন বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী বিদেশ থেকে আসা জাহাজগুলো বহির্নোঙরে অবস্থান করছে। সেখানে গিয়ে মেডিকেল টিম সরেজমিন পরিদর্শন করছে। যে জাহাজ জেটিতে ভিড়ছে তার নাবিকরা জ্বর, সর্দি, কাশি— এসব উপসর্গ আছে কি-না, স্ক্রিনিং করে দেখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নয় হাজার ৯৮৫ নাবিকের স্ক্রিনিং সম্পন্ন হয়েছে। বন্দর জেটি বা উপকূল থেকে বহির্নোঙরে মেডিকেল টিমের আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে জাহাজের লোকাল শিপিং এজেন্টের দেয়া স্পিডবোট ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন থেকে আমরা বন্দরে আসা সব জাহাজ ও বহির্নোঙরে অবস্থানরত জাহাজগুলোর নিয়মিত পরিদর্শন আরও জোরদার করব।’
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরে ১৯ জন এবং উপজেলাগুলোতে ১৩ করোনাভাইরাস পজেটিভ রোগী রয়েছেন। এদের মধ্যে নগরের দামপাড়া এলাকায় পাঁচজন, সাগরিকায় ছয়জন, সড়াইপাড়ায় একজন, হালিশহরে একজন, ফিরিঙ্গিবাজারে একজন, গোলপাহাড়ে একজন, সিডিএ মার্কেটে একজন, কাতালগঞ্জে একজন, উত্তর কাট্টলীতে একজন এবং নিমতলায় (বন্দর) একজন করোনার রোগী রয়েছেন।
এছাড়া সাতকানিয়ায় একজন, সীতাকুণ্ডে একজন, পটিয়ায় দুজন, বোয়ালখালীতে একজন এবং আনোয়ারাতে একজন করোনা পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে দুই নারী, এক শিশু ও এক বৃদ্ধ মারা গেছেন— জানান সিভিল সার্জন।
আবু আজাদ/এমএআর/পিআর