মাসুদ হাসান
Advertisement
আমরা এমন এক সময় অতিক্রম করতে যাচ্ছি, যা অতীতে কখনও করিনি। সামনের দিনগুলো আমাদের কাছে অস্পষ্ট। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। অতীতে বছরজুড়ে যতসংখ্যক মানুষ বিমানে ভ্রমণ করত এখন তা একদিনে করে। এমনকি ২০০ বছর আগেও এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে কয়েক মাস লেগে যেত। তাই অতীতে অনেক ভাইরাস বা ব্যাধি এই পৃথিবীর বুকে এলেও তা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যেতে পারেনি।
বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনাভাইরাস মাত্র তিন মাসে পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলেছে। পুরো পৃথিবী কার্যত লকডাউন অর্থাৎ স্থবির হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে যা কখনও ঘটেনি। তাই আমাদের সামনে এমন এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে যা আগে কেউ সম্মুখীন হয়নি।
বিশ্বজুড়ে সবার এখন একটিই প্রশ্ন ‘এই লকডাউন কবে শেষ হবে এবং পৃথিবী কবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে’? কার্যত এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ইতালি এবং সৌদিতে এক মাস হয়ে গেল লকডাউন চলছে অথচ এখনও করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মনে আসতেই পারে আর তা হচ্ছে লকডাউন ছেড়ে দিলে কী অবস্থা হবে? লকডাউন ছেড়ে দিলে ভাইরাস আবার ছড়িয়ে যাবে নাকি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে তা সময় বলে দেবে। তবে পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত।
Advertisement
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আশঙ্কা করেছে বিশ্বের প্রায় ৩৩০ কোটি মানুষ বেকার হয়ে যেতে পারে। আইএলওর আশঙ্কা আংশিক সত্য হলেও বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন হয়ে পড়বে গার্মেন্টস শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক। শুধু প্রথম সারির গার্মেন্টসগুলো টিকে থাকবে। বস্ত্র যেহেতু মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে একটি তাই পোশাকশিল্প বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই। তবে পণ্য বিক্রির জন্য গার্মেন্টস মালিকদের বিকল্প বাজার খুঁজে নিতে হবে।
গার্মেন্টস শিল্পের পর সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৪টি ব্যাংক এবং ৩৪টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার তাতে এতগুলো ব্যাংক এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো যৌক্তিকতা নেই। শুনলে অবাক হবেন ভারতের মতো দেশে ব্যাংকের সংখ্যা এখন ৩৪টি। বাংলাদেশে এতগুলো ব্যাংক অনুমোদনের পেছনে একটিই কারণ আর তা হচ্ছে রাজনৈতিক তদবির।
বর্তমানে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা, যা আমাদের অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের একটি সতর্কবার্তা দিয়ে আসছিল আগে থেকেই। বর্তমান মহামারিতে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংক একীভূত হয়ে যাবে বেঁচে থাকার তাগিদে। ব্যাংকগুলো সামনের দিনগুলোতে ব্যয় কমিয়ে আনার প্রতিযোগিতা শুরু করে দেবে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারাবে।
বাংলাদেশের জন্য আরও একটি দুঃসংবাদ হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে প্রবাসী আয় বা ফরেন রেমিট্যান্স মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। তাই সরকারকে পণ্য আমদানির ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। শুধু মৌলিক চাহিদার পূরণ করে যেমন কৃষি সরঞ্জাম, ওষুধের কাঁচামাল, জ্বালানি তেল ছাড়া সব অপ্রয়োজনীয় বিলাসীপণ্য আমদানি বন্ধ রাখতে হবে। আজ থেকে ২৫ বছর আগেও দেশি চকলেট, বিস্কুট, দেশি প্রসাধনী ছাড়া বাজারে তেমন বিদেশি পণ্য দেখা যেত না। অথচ এখন বিদেশি পণ্যে বাজার সয়লাব, যা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। সরকারকে সামনের দিনগুলোতে অপচয় বন্ধ করে সর্বোচ্চ মিতব্যয়ী হতে হবে।
Advertisement
এই মহামারিতে বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসবে বিলাসবহুল পণ্যের ওপর। মানুষ তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই হিমশিম খাবে। মৌলিক চাহিদার মধ্যে প্রথম চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। বিশ্ব এখন কার্যত লকডাউন কিন্তু তাতে মানুষের আহার কিন্তু বন্ধ নেই। যত দিন যাবে খাদ্যের মজুত তত কমে আসবে। সামনের দিনগুলোতে পুরো বিশ্বে খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। আর সেই জন্য বিশ্বের বড় বড় খাদ্য রফতানিকারক দেশগুলো যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, রাশিয়া, কাজাখস্তান খাদ্য রফতানি বন্ধ করে নিজেরাই মজুত করছে। করোনাকাল যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে প্রতিটি দেশ ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ করতে থাকবে। প্রতিবেশী দেশগুলো একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে খাদ্য খাদ্য এবং খাদ্য উৎপাদনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কৃষকের মাথার ওপর ছায়া হয়ে তাদের পাশে থাকতে হবে। কৃষকের বীজ, সার, এবং তাদের আর্থিক সহযোগিতা দিতে হবে। গার্মেন্টস শিল্পের কর্মহীন শ্রমিকদের নতুন ঠিকানা হয়ে উঠতে পারে কৃষিকাজ। সরকারকে খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকেও সচল রাখতে হবে। এই দেশে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা মধ্যস্বত্বভোগীরা। এদের জন্য কৃষক তার পণ্যের দাম পায় না। আবার শহরবাসীকে কৃষকের বিক্রয়কৃত দাম থেকে ১০ গুণ বেশি দামে সেই পণ্য কিনতে হয়। সরকারের উচিত হবে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করে তোলা।
মানুষ সব কষ্ট সহ্য করতে পারে কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারে না। দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। কোনো কারণে যদি সরকার খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বড় ধরনের অবনতি হতে পারে। কারণ ক্ষুধার্ত মানুষ ক্ষুধা নিবারণের জন্য সবকিছু করতে পারে।
তাই আমরা আশা করব দেশের স্বার্থে দেশের মানুষের স্বার্থে সরকার খাদ্য উৎপাদনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। খাদ্য ছাড়া মানুষকে বাঁচানো যাবে না। আর মানুষ না বাঁচলে দেশ এবং অর্থনীতি কিছুই বাঁচবে না। আগামীতে আমাদের স্লোগান হোক ‘খাদ্য খাদ্য এবং খাদ্য উৎপাদন করব। অপচয় বন্ধ করে সর্বোচ্চ মিতব্যয়ী হব’।
এইচআর/বিএ/পিআর