আন্তর্জাতিক

করোনা : বদলে দিয়েছে জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ে

করোনাভাইরাস আর সবার মতো পাল্টে দিয়েছে কেনিয়ার নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবন। জন্ম থেকে শুরু করে বিয়ে, মৃত্যু সবকিছুতে পরিবর্তন এনেছে এ মহামারি। কেনিয়ার সাংবাদিক জোসেফ ওয়ারুংগু জানিয়েছেন সেই কাহিনি।

Advertisement

কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির এক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সন্তানসম্ভাবা এক নারী। ৩২ সপ্তাহের অন্তসত্ত্বা তিনি। ডা. শীলা আটিয়েনোককে (ছদ্মনাম) সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হচ্ছে তার ওপর। এরকম কাজ তিনি এর আগেও বহুবার করেছেন। কিন্তু এবারের ঘটনাটি ঘটছে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে।

সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসা গর্ভবতী এই নারীর করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়েছিল। পরীক্ষায় দেখা গেছে তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত। কাজেই আর দশটি মায়ের স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের মতো ঘটনা এটি নয়।

ডা. আটিয়েনো একজন ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তার সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন ডাক্তার। যেসব গর্ভবতী নারীর করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, ওই হাসপাতালে তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব এই দলটির ওপর।

Advertisement

খুবই নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে ডা. আটিয়েনোর জীবন। তিনি বলেন, ‘আমি এমন সব গর্ভবতী মায়েদের দেখাশোনা করছি যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত, খুবই কঠিন মনে হয় ব্যাপারটা।’

তিনি আরও বলেন,‘আমাকে এখনই কোনো রোগীর সিজারিয়ান সেকশন করতে হবে। এর মানে হচ্ছে রোগীর দেহের অনেক রক্ত এবং বডি ফ্লুইডের সংস্পর্শে আসতে হবে আমাকে। অপারেশন করার সময় আমার শরীর যদিও ঢাকা থাকবে খুবই সুরক্ষিত স্যুটে বা পিপিইতে। এই পিপিই পরলে বেশ গরম লাগে, আর মোটেও আরামদায়ক নয়।’

‘আর যখন আমি বাড়ি ফিরে যাই, বাচ্চারা দৌড়ে আসবে আমার কোলে উঠার জন্য। কিন্তু কাপড়-চোপড় বদলে, গোসল করে, স্যানিটাইজার মেখে পরিচ্ছন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমি ওদের ছুঁতে পারি না। মানসিকভাবে, আবেগের দিক থেকে, এটা বেশ কঠিন। কিন্তু আমার তো কোনো উপায় নেই নতুন শিশুকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসা, সেটাই আমার কাজ। সেটা পৃথিবীতে মহামারি থাকুক আর না থাকুক।’বলছিলেন ডা. আটিয়েনো।

নববিবাহিত দম্পতি

Advertisement

তরুণ দম্পতি ফ্রান্সিস এবং ভেরোনিকা গিটোংগা হানিমুনে এসেছেন কেনিয়ার নিয়াহুরুরু এলাকায় তাদের গ্রামের বাড়িতে। যেটা কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে।

তারা তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান করেছেন গত ৫ এপ্রিল। প্রায় ৫০০ জনকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু যখন শেষ পর্যন্ত তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানটি হলো। তবে গির্জায় ঢুকতে দেয়া হয়েছিল মাত্র ছয় জনকে। বর, কনে, এক দম্পতি এবং দু’জন যাজক। আর কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনুমতি পাননি- না তাদের বাবা-মা, পরিবার, না কোনো বন্ধু-বান্ধব বা গ্রামবাসী।

কোভিড-১৯ এর কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য যেসব বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে, তাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারছেন না বহু মানুষ। এই দম্পতিই যখন বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান করলেন, সেখানে যেতে পেরেছিলেন মাত্র ১২ জন।

সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান স্থগিত রাখতে পারতেন। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, এর মধ্যেই বিয়ে করবেন।

গিটংগা বলেন, ‘আমাদের মনে হচ্ছিল ঈশ্বর যেন আমাদের বলছেন, বিয়েটা করে ফেলতে। আমি আর ভেরোনিকা তো একে অন্যকে গভীরভাবে ভালোবাসি। গির্জায় ঈশ্বরের সামনে আমরা দুজন এক সঙ্গে জীবন বাঁধবো, সেটাই তো আমরা সবসময় চেয়েছি।’

গিটংগা আরও বললেন, কোভিড-নাইনটিন কেবল তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাই বদলে দেয়নি, কিছু অপ্রত্যাশিত সুফলও এনেছে। বিয়ের অনুষ্ঠান করতে আমাদের খরচ করতে হতো প্রায় তিন লাখ কেনিয়ান শিলিং (২৮০০ ডলার)। কিন্তু অতিথিরা না আসায়, খাবারের খরচ এবং হল ভাড়ার খরচ বেঁচে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত মাত্র ৫০ হাজার শিলিং খরচ হয়েছিল ।’

একটি শোকার্ত পরিবার

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে কেনিয়ার সরকার যখন সন্ধ্যার পর কারফিউ জারি করেছে। আর কারফিউ অমান্য করায় ১৩ বছরের এক বালক ইয়াসিন হোসেইনকে গুলি করে হত্যা করেছিল পুলিশ।

এরকম ঘটনার শিকার ইয়াসিন একা হয়নি। দেশজুড়ে পুলিশ কঠোর হাতে যখন এই কারফিউ জারি করেছে, তখন তাদের মার খেয়ে হাত-পা ভেঙ্গেছে বহু মানুষ। গুরুতর আহত হয়েছেন অনেকে। কেনিয়ার এই পুলিশ বাহিনীর শ্লোগান আবার ‘সবার সেবায় নিয়োজিত।’

বিদ্রুপের শিকার এক রাজনীতিক

জেমস ওরেংগো কেনিয়ার এক সুপরিচিত রাজনীতিক। বিরোধী দল অরেঞ্জ ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট থেকে নির্বাচিত একজন সিনেটর। তিনি পেশায় একজন আইনজীবীও।

কিছুদিন আগে মিস্টার ওরেংগো একটি টুইট করেন। তিনি টুইটে লিখেছিলেন, ‘নিজে গাড়ি চালিয়ে পার্লামেন্টে গিয়েছিলাম কোভিড-১৯ টেস্ট করাতে। এই বিশ্ব মহামারি মোকাবিলায় নির্দেশনা মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

কেনিয়ার এক নাগরিক ক্রুদ্ধ হয়ে পাল্টা টুইট করলেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ তাহলে কোথায় যাব? রাজনীতিকরা তাহলে সত্যিই মনে করেন নিজে গাড়ি চালানো বিরাট এক বাহাদুরি? এই দেশের হয়েছেটা কী?’

শুধু ওই ব্যক্তি একা নন এই রাজনতিকের বিরোধিতা করেছেন অনেকেই। অথচ তিনি কেনিয়ার জনপ্রিয় একজন রাজনীতিবিদ।

সৌভাগ্যবান বন্দী

কোভিড-১৯ এর কারণে কেনিয়ায় এখন অনেক বিচার কাজ ডিজিটাল হয়ে গেছে। মেজিস্ট্রেটরা তাদের নির্দেশ জারি করছেন ভিডিও লিংকে। আর এ করোনাভাইরাসের কারণে অনেক অপরাধীকেও মুক্তি দিচ্ছে দেশটি। প্রায় ৪ হাজার ৮০০ বন্দীকে এর মধ্যেই মুক্তি দেয়া হয়েছে।

সুপারমার্কেট থেকে বাইবেল চুরির অভিযোগ আনা হয়েছিল এমন এক ব্যক্তিকে আটকের পর শাস্তি না দিয়ে মুক্তি দিয়েছে দেশটির একজন মেজিস্ট্রেট। ওই মেজিস্ট্রেট বিচারালয়ে না এসে এক ভিডিও বার্তায় ওই ব্যক্তিকে মুক্তির আদশে দেন। এই সংকটকালীন সময়ে এমন অপরাধে অনেককেই ছাড় দিচ্ছে দেশটির সরকার।

সূত্র: বিবিসি

এমএফ/জেআইএম