মহামারি, আগুন, দুর্ভিক্ষ- বরাবরই অন্য ধরনের নিরপেক্ষ। ধনী-গরিব সবাইকে এক চোখে দেখে। লোকালয়-দেবালয় ভেদাভেদ করে না। কাউকে ছাড় দেয় না। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস তা আরেকবার দেখিয়ে ছাড়ছে গোটাবিশ্বকে। পৃথিবী নামের গ্রহটিকে থমকে দিয়েছে এই করোনা। এর শেষ কোথায়? কেউ জানে না। এই অনুজীবটিকে রুখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মহাবিশ্বের বড় বড় মাথা, বড় বড় বিজ্ঞানী। নাস্তানাবুদ হচ্ছে বিশ্ব মোড়ল পরাক্রমশালী দেশগুলো।
Advertisement
যাদের হুংকারে, পরমাণু অস্ত্রের ঝংকারে বিশ্ব ছিল প্রকম্পিত; যাদের দাপটে, ভয়ে ম্রিয়মাণ ছিল তৃতীয় বিশ্বসহ গোটা দুনিয়ার অনগ্রসর রাষ্ট্রগুলো। সেখানে এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতিয়ে গেছেন, নেতানিয়াহু থমকে গেছেন। শব্দ কমে গেছে নরেন্দ্র দামোদর মোদির। অনেকদিন ধরে মিসাইল হামলা হয় না কোথাও। ড্রোন হামলা নামে কিছু একটা ছিল তা যেন ভুলে যেতে বসেছে আক্রান্তরা। আজ আর কোনো মসজিদ ভাঙা হচ্ছে না। মন্দির পোড়ানো হচ্ছে না, প্যাগোডা ধ্বংস করা হচ্ছে না। আঘাত করা হচ্ছে না কোনো গুরুদুয়ারায়।
করোনাদুর্যোগ মানবসমাজের অনেকের মনে চরম ভয়ের জন্ম দিতে পেরেছে। নিজের এবং স্বজনের মৃত্যুভয় মানসিকভাবে কাহিল করে তুলেছে অনেককে। এর জেরে গত ক’দিন দেশে-সমাজে বহু দুষ্ট লোককেও সমঝে যেতে দেখা যাচ্ছে। জীবনে আর দেখা নাও হতে পারে, কোনো অপরাধ করে থাকলে যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়- এমন একটি আবদারেরও বেশ চর্চা গত ক’দিন ধরে। ফোনে এমনকী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েও করা হচ্ছে কাজটি।
বলা যায়, ভয়ের কারণেই এই ক্ষমা চাওয়ার সাম্প্রতিক প্রবণতা। আবার একে কার্টেসি ভাবার বিষয়-আসয়ও যে নেই তা বলা যায় না। নইলে এই ক্ষমা চাওয়া ব্যক্তিদের কাউকে কেন পাওয়া যাচ্ছে না যিনি বলছেন বেঁচে গেলে ভালো হয়ে যাবেন। খাসলত পাল্টে ফেলবেন। আর অপকর্ম করবেন না। মিথ্যা বলা, ঘুষ খাওয়া, গিবত করা, মানুষকে অসম্মান করা ছেড়ে দেবেন। খাদ্যে ভেজাল দেয়া, ওজনে কম দেয়া, মজুতদারি, কালোবাজারি আর করবেন না।
Advertisement
এই দুর্যোগে মানবতা-ভালোবাসার অনেক ফেরিওয়ালার দেখা মিলছে। উল্টোটাও হচ্ছে। বিপরীত চরিত্রের আদম সন্তানের কাণ্ডকীর্তিও কম নয়। সর্বশক্তি নিয়ে আর্তমানবতার পাশে দাঁড়াচ্ছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণ বিতরণ করছেন, ক্ষুধার্তদের দ্বারে দ্বারে চাল-গম, ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ সে ত্রাণের চাল, গম চুরি করে গুদামে লুকাচ্ছে। কেউ কেউ নিজের ঘটের পয়সা খরচ করে মাস্ক বানিয়ে বিনামূল্যে গরিবদের মাঝে বিতরণ করছেন। কেউ কেউ বিশ টাকার মাস্ক সুযোগ বুঝে দুইশ টাকা বিক্রি করছেন।
কেউ বিনামূল্যে অথবা ন্যায্যমূল্যের থেকে কমমূল্যে ওষুধ বিক্রি করছেন। আবার কেউ কেউ দুইশ টাকার ওষুধ দুই হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। তিন টাকার ট্যাবলেটে লাভ গুনছেন তিনশ টাকা। কোনো কোনো ডাক্তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের সেবা দিচ্ছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, আবার কোনো কোনো ডাক্তার নিজের জীবন বাঁচাতে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গরিব বা কম আয়ের মানুষের কল্যাণে কেউ বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে, কেউবা সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে এসেছে। মাটির ব্যাংক ভেঙে, মুষ্টির চাল থেকে মন উজাড় করে দান করার বহু ঘটনাও রয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে। কেউ দিচ্ছে খাদ্য, কেউ দিচ্ছে অর্থ। কেউ বা দিচ্ছে প্রয়োজনীয় অন্যসব পণ্য।
এসব দানের ছবি তুলে রাখার কীর্তিমানের দেখাও মিলছে। তারাই বাংলাদেশ নয়। তাদের জন্য গোটা বাঙালিকে দায়ী করা সমীচীন নয়। দেশের দুর্যোগে ত্যাগের মহিমা ছড়ানো, আবার সুযোগ নিয়ে ফায়দা লোটা- দুটাই আমাদের বৈশিষ্ট্যে গেঁথে গেছে। এমন দ্বিচারিতা একাত্তরে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করার সময়েও ঘটেছে। কেউ যুদ্ধ করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভরণপোষণ দিয়েছে। আবার কেউ লুট করেছে। ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ করেছে। এই করোনাদুর্যোগেও কেউ গরিব পোষে। কেউ গরিব মারে। একদল ধারকর্জে অন্ন বিলায়। অন্যদল ত্রাণ লুকায়। এদেরকে উদাহরণ না টানাই ভালো।
যাপিতজীবনে মানবীয়-দানবীয় উভয় তৎপরতার সঙ্গে আমরা কবে থেকে পরিচিত? সন-তারিখ দিয়ে বলা মুশকিল। এটি ভাবনারও অবান্তর। বিক্ষিপ্ত কিছু মানুষের অপকর্ম বিবেচনায় গোটা বাঙালিকে গাল দিলে যারা অকুতোভয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাদেরকেও ছোট করা হয়। তারা হয়তো কোনো প্রতিদান বা সম্মানের অপেক্ষাও করছে না। সেইসঙ্গে একটা ভিন্ন বার্তাও জীবন্ত হয়ে উঠছে।
Advertisement
করোনাভাইরাস গোটা দুনিয়া মিসমার করে দেবে সেটা কেউ ভাবছে না। সেই শঙ্কা কেউ দেখছেন না। সবার বিশ্বাস এ সংকট একদিন কেটে যাবে। আবার বটতলা-হাটখোলা জেগে উঠবে। প্রাণোচ্ছল হবে ব্যাংক-বীমা, শেয়ারবাজার। শুরু হবে লক্ষ-কোটি টাকার লেনদেন। জমে উঠবে আলো ঝলমল বিপণিবিতান সুপারমল। আবার হাইকোর্টের সেরেস্তাদার, তিতাসের কেরানি, পাসপোর্ট অফিসের দপ্তরি কোটি টাকার বাড়ি বানাবে।
নইলে কেন প্রধানমন্ত্রীর কড়া হুঁশিয়ারি, তাৎক্ষণিক সাজা দেয়ার নির্দেশের পরও রিলিফের চাল চুরি থামছে না? কেবল চেয়ারম্যান-মেম্বর নয়, কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় আতিপাতি নেতা ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও এ চৌর্যক্রমে লিপ্ত। করোনাকে লাস্ট চান্স ভেবে চুরি-চামারিতে উতলা তারা। গত কয়েক বছর ধরে নন-স্টপে বলা হচ্ছিল- দেশে কোনো অভাব নেই। ভিক্ষা নেয়ার মতো লোক পাওয়া যায় না। মাত্র ক’দিনেই এখন কী চিত্র পথেঘাটে?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/বিএ/জেআইএম