করোনা সংকট মোকাবিলায় মানুষকে ঘরে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষকে ঘরে রাখার জন্য অবশ্যই তাদের খাবারের সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কারণ পেটে খেলে তবে পিঠে সয়। পেটে খাবার না পড়লে কোনো ব্যক্তিকেই দুই-একদিনের বেশি ঘরে আটকে রাখা যাবে না। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সরকারি হিসাব মতে, যেখানে প্রায় ৩৪ লক্ষ মানুষের হাতে নিয়মিত খাবার কেনার জন্য পর্যাপ্ত টাকা নেই, সেখানে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে ঘরে আটকে রাখা এভারেস্ট জয়ের চেয়েও কঠিন কাজ। যদিও সরকার ওই ৩৪ লক্ষ লোককে মাসিক দুই থেকে তিন হাজার টাকা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। পাশাপাশি অতিদরিদ্র মানুষকে ত্রাণ হিসেবে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার জন্য চাল ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন।
Advertisement
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ত্রাণ বিতরণের সাথে জড়িত অনেক জনপ্রতিনিধি ও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট চালের ডিলাররা ত্রাণের চাল আত্মসাৎ করছে। গত কয়েকদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাও ওই ত্রাণের চাল চুরির সাথে জড়িত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন তথা সরকারি কর্মকর্তারা জনপ্রতিনিধিদের ঘরের মাটি খুঁড়ে, বাথরুমে তল্লাশি চালিয়ে ওই ত্রাণের চাল উদ্ধার করছেন। কোথাও কোথাও স্থানীয় মানুষ ৯৯৯ ফোন দিয়ে অথবা নিজেরা স্বউদ্যোগে তল্লাশি চালিয়ে ওই ত্রাণের চাল উদ্ধার করছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের ওই প্রতিরোধের ফলে ইতোমধ্যে ২১৭৪ বস্তা ত্রাণের চাল উদ্ধার করা হয়েছে। অবশ্যই এখনও ৫৫০ বস্তা ত্রাণের চালের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
ত্রাণের চালচোরদের বিরুদ্ধে সরকার বারবার কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তাদের কেন দমন করা যাচ্ছে না তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। ত্রাণের সামগ্রী চুরি অবশ্যই নতুন কোনো ঘটনা নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশকেও সরকারপ্রদত্ত ত্রাণসামগ্রী সরকারি দলের লোক চুরি করেছে দলবেঁধে। ১৯৭৩ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য আট কোটি কম্বল আসে বিদেশ থেকে। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতির কারণে তা সাধারণ মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছায়নি। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য আট কোটি কম্বল আসলেও তার কম্বল কোথায় সেই প্রশ্ন উত্থাপন করে তিনি তৎকালীন জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সব সরকারের সময়েও ওই জনগণের জন্য প্রেরিত বিভিন্ন সরকারি সাহায্য চুরির ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় তৎপর হয়ে ওই সব ত্রাণসামগ্রীর কিছু অংশ উদ্ধার করেছে। কিন্তু ত্রাণচুরির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি কখনও হয়নি।
আজকের ত্রাণ চোররাও জানে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। ইতোমধ্যে মাদারীপুরের এক চাল চোর জামিনে মুক্ত হয়ে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইতঃপূর্বে স্বাধীন বাংলাদেশে ত্রাণ চোরদের শাস্তি হলে বর্তমান চাল চুরির ভয়াবহ ঘটনা ঘটত না। দুর্নীতির শিকড় জনপ্রতিনিধিদের রন্ধে রন্ধে লালন করার ওই দায় শুধু রাষ্ট্রে নয়, সাধারণ মানুষেরও। সাধারণ মানুষ যদি ওই ত্রাণ চোরদের স্থায়ীভাবে সামাজিভাবে বয়কট করতেন তাহলে নতুন ত্রাণ চোরের জন্ম হতো না। কিন্তু বাংলাদেশে সবাই জানে টাকা হলে সমাজে সম্মান কেনা যায়। সারাজীবন ঘুষ খাওয়া দুর্নীতি করা ব্যক্তিরাই মসজিদ কমিটি, ঈদগা কমিটির সভাপতি হন। তাদের নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মাহফিল হয়। ভালো মানুষদের সৎ মানুষদের সামাজিক বিভিন্ন জায়গা নেতৃত্ব না রেখে ওই দুর্নীতিবাজ ঘুষঘোর চালচোরদের সামাজিক নানা কাজে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের অর্থবিত্ত প্রধান ভূমিকা রাখে। বছরের পর বছর বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থার দিকে তাকালে এই চিত্র দেখা যাবে। তাই আজকের চালচোররাও জানে যেভাবে হোক এই সুযোগে যদি চাল চুরি করে অগাধ টাকার মালিক হওয়া যায় তাহলে আজ হোক কাল হোক তারা সামাজে নিজেদের অর্থের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। তাই আদাজল খেয়ে তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চাল চুরির উৎসবে মেতেছে।
Advertisement
প্রকৃপক্ষে চাল চুরিসহ সব দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে স্থায়ীভাবে বয়কট তাদের জন্য বড় শাস্তি হতে পারে। যেসব জনপ্রতিনিধি চাল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন ওই এলাকার জনগণের উচিত ওই জনপ্রতিনিধিদের একঘরে করার ঘোষণা দেয়া। আগামী বছর পাঁচেক যদি সামাজিকভাবে ওই চালচোরদের একঘরে করে রাখা যায়, তাদের সাথে সব সামাজিক সম্পর্ক বর্জন করা যায় তাহলে তা তাদের ও অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হবে। মানুষ অর্থবিত্তের মালিক হতে চায় সবসময় ওই অর্থে বাড়ি গাড়ি করে নিজের ভোগবিলাস করার জন্য নয়। সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়ই তার মূল লক্ষ্য থাকে। অবৈধ অর্থে বাড়ি গাড়ি করার মূল লক্ষ্য থাকে সামাজিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। অন্যকে দেখানো তিনি অনেক অর্থের মালিক। তাই সাধারণ মানুষ যদি ওই চালচোরদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে পারে তাহলে চালচোরদের মনোবল অনেকটা ভেঙে পড়বে। পরিবারের অন্য সদস্যদের চাপে আর কখনও এমন অন্যায় কাজের সাথে যুক্ত হবে না।
মনে রাখা দরকার সাধারণ জনগণের চেয়ে বড় শক্তি আর নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এদেশের রাজনীতিবিদ, আমলা পুলিশসহ নানা পেশায় যুক্ত ব্যক্তিদের মতো সাধারণ মানুষকেও কেনা যায়। যুগ যুগ ধরে দুর্নীতিবাজ, চালচোররা অর্থের বিনিময়ে সাধারণ মানুষকে কিনে নিচ্ছে। ফলে সামাজিকভাবে কখনওই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিরোধ লক্ষ্য করা যায়নি। সামাজিক প্রতিরোধ বিহীন একটি সমাজে দুর্নীতিবাজ চালচোরদের সংখ্যা বাড়বে এটা অস্বাভাবিক নয়। রাষ্ট্রীয় আইনে সাজা দিয়ে সবসময় দুর্নীতিবাজ দমন করা যায় না। সামাজিক প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় শক্তি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে সেই প্রতিরোধী চেতনা নিয়ে চালচোরদের বর্জনে সাড়া দিতে হবে। ওই বর্জন মানে শুধু যারা চাল চুরি করছেন তাদের গ্রেফতার বা চালচোরদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়া নয়, পাশাপাশি স্থায়ীভাবে তাদের বর্জন করতে হবে।
অগাধ টাকা দিলেও তাদের ঈদগা কমিটি, পূজা কমিটি, মসজিদ কমিটি, স্পোর্টস কমিটি, ওয়াজ মাহফিলের কমিটি, স্কুল কমিটি, কলেজ কমিটি তথা প্রভৃতি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কোনো পদেই নিযুক্ত করা যাতে না হয় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে চালচোরদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বর্জন ও নতুন সম্পর্ক স্থাপন না করার পাশাপাশি তাদের পরিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আগামী কয়েক বছর যদি সাধারণ জনগণ এভাবে চালচোরদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে পারে তাহলে চালচোরদের প্রকৃত শাস্তি নিশ্চিত হবে। ওই শাস্তি দেখে নতুন আর কেউ চাল চুরি করতে আগ্রহী হবে না। দুর্নীতি করতে সাহস পাবে না।
সামাজিকভাবে বর্জনের পাশাপাশি আইসল্যান্ডের ফর্মুলায় চালচোরদের শাস্তি দেয়া যেতে পারি। আইসল্যান্ডে প্রতি বছর দুর্নীতিবাজদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় এবং শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের ছবি ওই দেশের পাবলিক টয়লেটগুলোয় সাঁটিয়ে দেয়া হয়। সাধারণ মানুষ ওই পাবলিক টয়লেটে দুর্নীতিবাজদের ছবির ওপর মলমূত্র ত্যাগ করে। বাংলাদেশেও কিছুদিন আগে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ পুলিশ মাদক নিয়ন্ত্রণে মাদক কারবারিদের বাড়ি চিহ্নিত করে দিয়েছিল। এখন সময় এসেছে চালচোরদের বাড়ির সামনে সানইবোর্ড টানিয়ে দেয়ার। পাশাপাশি সরকার চালচোরদের ছবিগুলো পাবলিক টয়লেটে সাঁটিয়ে দিতে পারে। সরকার যদি উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিজ উদ্যোগে বা জনসাধারণ নিজ উদ্যোগে আইসল্যান্ডের ফর্মুলায় চালচোরদের ছবি পাবলিক টয়লেটে সাঁটিয়ে দিতে পারে। এভাবে চালচোরদের যদি সামাজিকভাবে হেয় করা যায় তাহলে আশা করা যায় এদেশ একদিন চালচোর দুর্নীতিবাজ মুক্ত হবে।
Advertisement
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/জেআইএম