ফিচার

করোনার ভয়ে উৎসব বিহীন পহেলা বৈশাখ

‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’- কথাগুলো হয়তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু আজকের দিনটির জন্যই বলেছিলেন। কেননা একদিকে করোনাভাইরাসের দৌরাত্ম্য, অন্যদিকে বাঙালির চিরায়ত উৎসবের দিন ‘পহেলা বৈশাখ’। অথচ এ উৎসব পালন করার সাধ্য নেই কারো। সবাই আজকের এ দিনেও গৃহবন্দি। করোনার সঙ্গে লুকোচুরি খেলেই কেটে যাচ্ছে সময়।

Advertisement

আজ পহেলা বৈশাখ। ১৪২৭ বঙ্গাব্দর প্রথম দিন। আজ তো স্বপ্ন দেখার দিন। অথচ করোনা এসে আমাদের দুঃস্বপ্ন দেখাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। আজ নবীন আলোয় হারিয়ে যাওয়ার দিন। অথচ করোনার আঁধার আমাদের প্রতিনিয়ত গিলে খাচ্ছে। পুরাতন ও জরাজীর্ণকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দিন। অথচ আমরা মহামারীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।

চৈত্র শেষেই বাঙালির মনে নতুন বছর বরণের একটি উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা যেত। গ্রামাঞ্চলে ফসল তোলা, ঘর-দোর পরিষ্কারের প্রস্তুতি চলতো। পাশাপাশি গ্রাম ও শহরে বৈশাখী মেলা, নতুন কাপড় কেনা, পান্তা-ইলিশের আয়োজন করা হতো। কিন্তু এ বছর চৈত্র সংক্রান্তিও যেমন চুপিসারে বিদায় নিয়েছে, তেমনই মুখভারে বিদায় নিতে যাচ্ছে পহেলা বৈশাখও।

কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে হয়তো এই প্রথম পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বর্জন করা হলো। যেখানে মানুষ গৃহবন্দি; সেখানে রাজপথে, মাঠে-ঘাটে উৎসব করার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। করোনার কারণে দেশে চলছে অঘোষিত লকডাউন। সরকারের পক্ষ থেকে পহেলা বৈশাখের সব ধরনের অনুষ্ঠান ও জনসমাগম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

Advertisement

তাই এবার আর রমনার বটমূলে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, পুরান ঢাকায় উৎসবের আমেজ নেই। হয়নি কোনো মঙ্গল শোভাযাত্রা। আজ কোথাও কোনো ধরনের উৎসব বা অনুষ্ঠান হবে না। এই প্রথম ঘরে বসেই পালন করা হবে পহেলা বৈশাখ। ঢাক-ঢোল, বাদ্য-বাজনা কিছুই থাকবে না। অনেকের ভাগ্যে হয়তো পান্তা-ইলিশও জুটবে না।

পহেলা বৈশাখ একান্তই বাঙালির উৎসব। পহেলা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। হাজার বছরের ঐতিহ্যের বহমানতায় আজ আনন্দ-উৎসবে বাঁধাভাঙা উল্লাসে মেতে ওঠার কথা ছিল। অগণিত মানুষ ঘরের বাইরে ছুটে আসার কথা ছিল। অথচ আজ কোনো আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তরে।

তবুও আশা করি, করোনা প্রতিরোধ করতে মানুষ ঘর থেকে বের না হলেও নতুন বছরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো সব জরা-গ্লানি মুছে ফেলে সবাই আবার গেয়ে উঠবে নতুন ঝলমলে দিনের গান। আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার হিসাব শেষে শুরু হবে অবিরাম পথচলা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ- গোত্র নির্বিশেষে সবাই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে শপথ নেবে। আর এ শপথ হবে করোনা প্রতিরোধের। করোনাকে জয় করার।

নির্মাতা ও নাট্যকার সাজিন আহমেদ বাবু বলেন, ‘কতশত বছর পর প্রকৃতি নিজের মতো করে বৈশাখ পালন করবে। আজ পাখিরা ইচ্ছেমতো ওড়াউড়ি করবে। পাতার সাথে পাতার হবে কথোপকথন। পায়ের ধুলো আজ বকুলতলার বকুল পাতাকে মারাবে না। এবারের বৈশাখটা গাছ, পাতা, পাখি ও বাতাসের। আমাদেরও! শুদ্ধ বৈশাখ! এবারের বৈশাখ ঘরে থেকে পরিবারের সাথে পালন করার সৌন্দর্যটাই আলাদা।’

Advertisement

উৎসব বিহীন বৈশাখ সম্পর্কে কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক বলেন, ‘আবহমান কাল থেকেই বাঙালির প্রধান অসাম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখ। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-পেশা-বয়স; নির্বিশেষে বাঙালিরা এইদিনের মহামিলনে যোগ দিয়ে আসছে। কিন্তু এবার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনার ছোবলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য যেমন কেড়ে নিয়েছে, তেমনি ছিনিয়ে নিয়েছে পহেলা বৈশাখের নির্মল-অসাম্প্রদায়িক আনন্দও। আজ আর প্রিয়জনের সঙ্গে আলিঙ্গন নয়, দূর থেকে মঙ্গলকামনাই ব্রত বাঙালির। সমগ্র জাতিরও। তবু সবার জীবনে ফিরে আসুক সুস্থ-স্বাভাবিক দিন, ঘরে ঘরে আবার বেজে উঠুক সুর। শিশুরা আবার মেতে উঠুক শঙ্কাহীন কোলাহলে।’

তাই আজ সবটুকু গ্লানি, ক্ষোভ, হতাশা, দুঃখ ভুলে গিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথ নেওয়ার দিন। অসহায়-দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দিন। অন্নহীনের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার দিন। তাহলেই আমাদের আজকের বর্জন করা উৎসব আগামীতে কল্যাণময় হয়ে উঠবে।

এসইউ/এমকেএইচ