মতামত

ওদের ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই

অসহ্য ওরা, অবিশ্বাস্য রকমের অবিবেচক এবং অতিমাত্রায় নির্দয়। এত লোভ কেন ওদের? মানুষের অভাব, শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ কিছুই কী ওদের কর্ণকুহরে একদম প্রবেশ করে না, ওদের অন্তরকে কি এতটুকু দ্রবীভূত করে না? আমাদের প্রধানমন্ত্রী দিনরাত্রির সামান্যতম বিশ্রামও পরিহার করে, শরীরের সীমাবদ্ধতা এবং বয়সের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে যেভাবে মানুষের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করার জন্য নিরলস শ্রম দিয়ে চলেছেন তার জন্য কি রক্তপিপাসু খাদকেরা এতটুকু তাদের লোলুপ জিহবা সংবরণ করবে না?

Advertisement

আমাদের এই দেশ আজ এক অবিশ্বাস্য যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। মহাযুদ্ধের চাইতেও এ অনেক বেশি ব্যাপক, অনেক বেশি বিধ্বংসী। প্রাণঘাতী চেতনানাশক একটি মহাযুদ্ধের করালগ্রাসে নিপতিত এখন এই পৃথিবীর কয়েকশ কোটি মানুষ, আর এরই মধ্যে একদল লোভাতুর হিংস্র শ্বাপদ তাদের বিষাক্ত দাঁত দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে মানবতা- এ কি ভাবা যায়!

পত্রিকায় এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে চিত্র উঠে আসছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। জোটবেঁধে দুর্বৃত্তরা নেমে পড়েছে নগরে বন্দরে, গ্রামেগঞ্জে, জনপদে। মাত্র দুই সপ্তাহে উদ্ধার করা গেছে ত্রাণের দুই সহস্রাধিক বস্তা চাল, এখনও পর্যন্ত হদিস পাওয়া যায়নি প্রায় এক হাজার বস্তার। এ তো গেল সরকারি হিসাব। আর লোকচক্ষুর আড়ালে নানা ছলচাতুরী এবং কৌশলে আরও কত বস্তা লোপাট হয়েছে কে জানে। ত্রাণের চালভর্তি তিনটি ত্রাণবাহী নৌযান ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে রহস্যজনকভাবে। বিভিন্ন জায়গায় আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকে। এদের বেশ কয়েকজন সরকারি দলের ভেতরে ঢুকে পড়া দুর্বৃত্ত।

একদিকে যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি প্রশাসনিক অংশ নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সদস্য উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রাণপাত করে চলেছে, বিভিন্ন অঞ্চলের জনদরদী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এখন নিজেদের ক্ষুদ্রস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসছেন, অন্যদিকে তেমনি অন্ধকারের শ্বাপদরা অসহায় মানুষের মুখের গ্রাসটুকু লুণ্ঠন করতে পথে নেমেছে।

Advertisement

এই পরিস্থিতি আমাদের অচেনা নয়, এই চেহারাগুলোও আমাদের অজানা নয়। দেশ ও জাতির বিভিন্ন দুর্যোগে এই হিংস্র প্রাণীগুলো অন্ধকারের গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসে বিষাক্ত করে করে দেয় সবকিছু। এরা সর্বনাশ করে দেয় আমাদের চলার পথকে। এরা লুট করে আমাদের স্বপ্নকে, অমিত সম্ভাবনাকে।

মনে পড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তৃতার কথা। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কুমিল্লায় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি সে সময় যা বলেছিলেন আজ তা প্রচণ্ডভাবে প্রাসঙ্গিক। আমি পাঠকদের জন্য সেটা এখানে অবিকৃতভাবে তুলে ধরছি- “এত রক্ত দিয়ে যে স্বাধীনতা এনেছি তবু চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয় নাই। এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরী, বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বৎসর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি,- চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। কিন্তু আর না। বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। এ মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই। কাল যখন আমি আসতেছিলাম ঢাকা থেকে তখন দেখি হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখবার জন্য। তারা না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে, গায়ে কাপড় নাই, কত অসুবিধার মধ্যে তারা বাস করতেছে। আমি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি তোমরা আমাকে এত ভালোবাসো কেন? কিন্তু যেই দুঃখী মানুষ দিনভরে পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, পেটে খাবার নাই, বাসস্থানের বন্দোবস্ত নাই, লক্ষ লক্ষ বেকার, পাকিস্তানিরা সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে, কাগজ ছাড়া আমার কাছে কিছু রেখে যায় নাই, বিদেশ থেকে ভিক্ষে করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চাটার দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে লুটতরাজ করে খায়। আমি শুধু এমারজেন্সি দেই নাই, এবার আমি প্রতিজ্ঞা করেছি,- যদি পঁচিশ বছর এই পাকিস্তানি জালেমদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, এহিয়া খানের মধ্যে বুকের পাটা টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি, আর আমার তিরিশ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তাহলে পারবো না- নিশ্চয়ই, ইনশাআল্লাহ পারবো। এই বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, মুনাফাখোর ও চোরাকারবারিদের নির্মূল করতে হবে, আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও, বাংলার মানুষও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করুক। আর না, সহ্যের সীমা হারিয়ে ফেলেছি। এই জন্য জীবনের যৌবন নষ্ট করি নাই, এই জন্য শহীদরা রক্ত দিয়ে যায় নাই। কয়েকটা চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে দিয়ে আসে, জিনিজপত্র গুদাম করে মানুষকে না খাইয়ে মারে, উৎখাত করতে হবে বাংলা বুক থেকে এদের। দেখি কতদিন তারা টিকতে পারে। চোরের শক্তি বেশি, নাকি ঈমানদারের শক্তি বেশি সেইটা আজ প্রমাণ হয়ে যাবে।”

প‍ঁচাত্তরের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু যখন এই আহ্বান জানান তখন তার চারপাশে ছদ্মবেশীদের প্রাদুর্ভাব ছিল। তার প্রশাসনের সিংহভাগ গ্রাস করে ফেলেছিল বঙ্গবন্ধু কথিত ‘চাটার দল’ এবং মোশতাক বাহিনীর গুপ্তচরেরা। তখন আন্তর্জাতিক বলয়ের একটি বৃহৎ অংশ ছিল ভীষণভাবে বাংলাদেশবিরোধী। কিন্তু এখন তো বিশ্ব পরিস্থিতি অনেকখানি বদলেছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিষ্ঠা, সততা, একাগ্রতা এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেশকে এক ঈর্ষণীয় উচ্চতায় নিয়ে চলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশও এখন প্রধানমন্ত্রীর নিষ্ঠা এবং নেতৃত্বের প্রতি যথেষ্ট ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। এই পরিস্থিতিতে যারা গরিব মানুষের ক্ষুধার অন্ন আত্মসাৎ করে, সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে, সাধারণ মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলে তাদের প্রতি সামান্যতম ক্ষমা প্রদর্শন পরিগণিত হবে দুর্বলতা হিসেবে।

Advertisement

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি প্রাণবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত এবং জাতির জনকের আদর্শের বিশ্বস্ত পতাকাবাহী হিসেবে যে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবণিতা এই যুদ্ধের সৈনিক হবে নিঃসন্দেহে। আপনি শুধু কঠোর হন, দানব দমনে কঠোর। অঙ্কুরে বিনাশ করুন শত্রুকে। জাতি আপনার সঙ্গে আছে।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ।

এইচআর/বিএ/জেআইএম