আধিপত্য বিস্তার ও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংঘর্ষে জড়ানো রীতিমতো ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। পান থেকে চুন খসে পড়লেই দা, লাঠি, টেঁটা, ফলা ও বল্লমের মতো দেশীয় মারণাস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই পক্ষ। যুগ যুগ ধরে চলা এসব গ্রাম্য সংঘর্ষে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। আবার আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন অনেকে।
Advertisement
পুলিশের ভাষ্য মতে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে নিজেদের পেশিশক্তি দেখানোর জন্য গ্রামের সর্দাররা দাঙ্গা লাগিয়ে রাখেন। এলাকায় যার আধিপত্য থাকে তিনি আর্থিকসহ নানা সুবিধা ভোগ করেন। এর ফলে ছোট-খাটো ঘটনাগুলোকে সংঘর্ষে রূপ দেন ওই গ্রাম্য সর্দার-মাতব্বররা। প্রতিটি সংঘর্ষের ঘটনায় থানায় মামলা হয়। আর মামলা চালানোর জন্য আসামিদের কাছ থেকে তোলা হয় চাঁদা। এই চাঁদার বেশিরভাগ টাকা নিজেদের পকেটে ঢোকান সর্দাররা।
প্রবাসীরাও এক্ষেত্রে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন। নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে মারামারি হলে মামলা চালানোর খরচ দেন তারা। পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্র কেনার জন্যও টাকা আসে প্রবাস থেকে। এর ফলে বন্ধ হচ্ছে না গ্রাম্য সংঘর্ষ।
গত দুই সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কয়েকটি গ্রাম্য সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে একজন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
Advertisement
গত ৩১ মার্চ জেলার সরাইল উপজেলার পাকশিমুল ইউনিয়নের ভূইশ্বর গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত অর্ধশত মানুষ আহত হন। পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনে। পানি নিষ্কাশনের ড্রেন নির্মাণ নিয়ে ওইদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েক দফায় ভূইশ্বর গ্রামের বর্তমান ইউপি সদস্য মলাই মিয়া ও সাবেক ইউপি সদস্য নাসির উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। রাস্তার পাশে দল বেঁধে সংঘর্ষে অংশ নেন দুই পক্ষের কয়েকশ লোক।
গত ১ এপ্রিল লুডু খেলা নিয়ে আশুগঞ্জ উপজেলার বড়তল্লা গ্রামে ঘটে তুলকালাম কাণ্ড। কয়েকজন কিশোরকে স্মার্টফোনে লুডু খেলতে নিষেধ করলে তা নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে বাধে গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ। গ্রামের জামাল গোষ্ঠী ও রাব্বানী গোষ্ঠীর কয়েকশ লোক জড়িয়ে পড়েন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। এতে আহত হন অন্তত অর্ধশত মানুষ। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ে ওই সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনে।
নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের ফকিরদিয়া গ্রামে কিশোররা ক্রিকেট খেলতে চাইলে করোনাভাইরাসের কথা বলে স্থানীয় কয়েকজন তাদের বাধা দেন। এ নিয়ে কিশোরদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এর জেরে গত ১ এপ্রিল সকালে ফকিরদিয়া গ্রামের মুন্সিবাড়ির শাহ হোসেনের লোকজন ও সরকার বাড়ির আলমগীর মিয়ার লোকজন সংঘর্ষে জড়ান। দুই ঘণ্টা ধরে চলা ওই সংঘর্ষে নারীসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকটি ঘর-বাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়।
এরপর ৪ এপ্রিল সকালে জেলার কসবা উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে জমিতে মাটি কাটা নিয়ে দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তানভীর (২২) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন।
Advertisement
একই দিনে মার্বেল খেলা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরশহরের ভাদুঘর দক্ষিণপাড়ায় শিশুদের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া হয়। শিশুরা সেই ঝগড়ার কথা বাড়িতে জানানোর পর সেটি রূপ নেয় গোষ্ঠীগত সংঘর্ষে। ওইদিন সন্ধ্যায় মোল্লাবাড়ি ও শেখবাড়ি গোষ্ঠীর লোকজনদের ওই সংঘর্ষে চোখ হারান মোজাহিদ নামে এক তরুণ। এ ঘটনায় আহত হন আরও ১৫ জন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
৫ এপ্রিল সরাইল উপজেলার পাকশিমুল ইউনিয়নের পরমানন্দপুর ও বড়উছড়া গ্রামের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় গান গাওয়ার জেরে ওই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
১২ এপ্রিল আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের থানাকান্দি গ্রামে দুই পক্ষের শত শত লোক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জড়িয়ে পড়েন সংঘর্ষে। সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষের এক সমর্থককের পা কেটে নিয়ে আনন্দ মিছিল করে আরেক পক্ষ। সেই মিছিল থেকে দেয়া হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ৩০ জন। এছাড়া উভয় পক্ষের বেশ কয়েকটি ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
মূলত আধিপত্য বিস্তার নিয়েই সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় শান্তি সমাবেশ করে দেশীয় অস্ত্র জমা নেয়া হলেও বন্ধ হচ্ছে না গ্রাম্য সংঘর্ষগুলো।
জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন, পুলিশের কঠোর আইন প্রয়োগ ছাড়া গ্রাম্য সংঘর্ষ বন্ধ করা সম্ভব নয়। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আর এ কাজে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারসহ সকল জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভৈাকে জিয়াউল হক মৃধা বলেন, যারা প্রবাসে থাকেন তুলনামূলকভাবে তাদের আয়-উপার্জন একটু বেশি। কোনো প্রবাসীর গোষ্ঠীর যদি কেউ অনাহারে বা কষ্টে থাকেন তাহলে তার পাশে না দাঁড়িয়ে যখন তার গোষ্ঠীর সঙ্গে আরেক গোষ্ঠীর ঝগড়া হয় তখন ঘোষণা দিয়ে বলে আমি এত টাকা দেবো, তোমরা চালিয়ে যাও। মূলত নিজের নাম জাহিরের জন্য প্রবাসীরা এসব করে থাকেন। নিজেকে জাহির করার জন্য লাঠি, টোঁটা, বল্লম, হেলমেট কিনতে বিদেশ থেকে টাকা পাঠান তারা।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় আইনের যে ধারায় মামলা হয় সেই ধারাগুলো জামিনযোগ্য। এর ফলে তদন্ত করে আমরা যখন চার্জশিট দেই তখন আসামিরা জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। আর যারা সংঘর্ষগুলো লাগায় তাদের আর্থিকভাবে অনেক লাভ আছে। তবে আমরা আমাদের দিক থেকে কঠোর অবস্থানে আছি।
আরএআর/এমকেএইচ