নাই কোনো ঢাকের বাদ্য, বাজে না করতাল- এ আবার কেমন বৈশাখ! করোনাভাইরাস বিপন্ন এ বিশ্ব জনপদে দৃশ্যত নেই কোনো মানুষ। জ্বরের ঘোরে কাঁপছে বিশ্ব। চারদিকে ছোপ ছোপ আতঙ্ক। এরপর কে, এরপর কার পালাক্রম! রোগ শুরু হলে পাশে কেউ নেই। সব সুনসান নিরালা। একলা চলার প্রস্তুতি নিতে নিতে কখনো একলা বসে ভাবি- আমি কার, কে কাহার!
Advertisement
হায়, তবুও থেমে থাকে না জীবন। থেকে থাকে না ক্ষুধা, থেমে নেই জন্ম। সেই সাথে নিয়ত চলমান থাকে সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর আবর্তন। প্রতিদিন ওঠে নতুন সূর্য। বছর ঘুরে সে নিয়ে আসে নতুন বছর। বছরের পরিক্রমণে ফিরে আসে বৈশাখ। তবে এবারের বৈশাখ চির অচেনা। ভিন্ন তার শান্ত সৌম্য রূপ। কোথাও কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই। এ আমাদের অন্য বৈশাখ।
জীবনটা হঠাৎ করে একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। বৈশাখের সাত সকালে তাড়াতাড়ি খোঁপায় বেলীফুল গুঁজে এবার আর দৌড়ানো হবে না বকুলতলায়। হাওয়াই মিঠাইয়ের মিহি রঙে গোলাপি হবে না ঠোঁট। মুড়ি-মুড়কি-বাতাসার ঠোঙা হাতে নিয়ে আমরা সনাতনী গানের তালে দুলে দুলে সঙ্গত দেব না। হায়, এ কেমন বৈশাখ!!
বৈশাখ আমাদের বাঙালিদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থান দখল করে আছে। এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে শুরু হয় বাংলা বছরের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখ মানে নতুন দিনের শুরু। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এই দিনে উৎসবে আনন্দে মেতে ওঠে। আমাদের শৈশব পহেলা বৈশাখের সাথে স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে। মায়ের আঁচলের কোণা ধরে আবদার শুরু করতাম ক’টা টাকার জন্য। পাড়ার আরও ছেলেমেয়েদের সাথে করে মেলায় যেতাম। তখনকার মেলাগুলোতে হালের মেলার মতো এত জাঁকজমক ছিল না। কিন্তু কী এক মায়া ছিল! মেলায় গিয়েই প্রথমে একটা বাঁশের বাঁশি কিনতাম। সুর তুলতে না পারলে কী হবে, সেই প্যা পোঁ আওয়াজেই কী মায়া! মনে আছে, আরেকটা জিনিস মেলায় গেলে আমার নিতেই হতো। একটা টিনের জাহাজ। এই এতটুকুন একটা টিনের জাহাজের ওপর লাল রঙ করা। কেরোসিনের তেল ঢেলে সলতেয় আগুন দিলাম। বাড়ির পাশের ছোট্ট ডোবায় ছেড়ে দিলে ভটভট আওয়াজ তুলে তার সেকি দৌড়!
Advertisement
সংক্রান্তির আগেই একটা রঙিন জামা ধুয়েটুয়ে গুছিয়ে রাখতাম। আলতায় ভরিয়ে দিতাম ছোট্ট দুটো পা আর হাতের আঙুল। একটু বড় হলে চুলে ফুল গোঁজা শিখেছিলাম। আমাদের বাড়িতে বৈশাখে পায়েস আর মুগডালের ভুনা খিচুরি রান্না হতো। বিকেলে মেলা থেকে ফেরার পথে ঝড় শুরু হতো। সেকি ঝড়! কালবৈশাখীর ঝড়। পায়ের কাছে উড়ে এসে আছড়ে পড়ে গাছের মরা ডাল। ভয়ে দুরু দুরু বুক, বাড়ি ফিরলে অবধারিত মায়ের বকুনি। কিন্তু হাতে ধরা থাকত সেই যে বাঁশি, সেই যে টিনের জাহাজ, সেই যে ররীন্দ্রনাথের মূর্তি- তারা আমার সকল ভয় ভুলিয়ে দিত। আমার ছোট্ট দুহাতে বুকের খিঁচে ধরে রাখা খেলনাগুলো আমায় আশ্চর্য সাহস দিত।
বড় হতে হতে দৃশ্যপট বদলে গিয়েছিল। আমরা দলবেঁধে টিএসসি, চারুকলা, বকুলতলায় সারাদিন আনন্দে মেতেছি। কাগজের মুখোশে মুখ ঢেকে আনন্দে হেসেছি। বাঙালির বাঙালিয়ানায় কমতি রাখিনি কিছুই। অদুরে কোথাও গানের দল এসেছে। ছুটে গিয়ে গান শুনেছি। কিন্তু মেলা মূলত আমার শৈশবকেই ধারণ করে। আমি আমার বৈশাখকে রাঙিয়ে দিতে প্রতি বছর আলতার শিশি কিনেছি। শুধু এ বছরটা অন্যরকম। শুধু এ বছরটাতেই রঙ নেই।
চৈত্র সংক্রান্তির বিকেল বেলা বসে ভাবছিলাম, আগামীকালই বৈশাখ। বৈশাখ মানে কাঁচা আমের মন কেমন করা ঘ্রাণ! এবারও বৈশাখ ফিরে এসেছে। এবারের বৈশাখে মানুষের ঘরে ঘরে নীরবে চলে কান্নার উৎসব। এক ঘাতক ব্যাধি কেড়ে নিয়েছে আমাদের চৈত্র সংক্রান্তি, আমাদের বৈশাখ। পৃথিবীর সব মানুষ এক রোগের ভয়ে কাঁপছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঘরে থাকো- এতে তোমার মুক্তি। আমরা প্রকৃতির রুক্ষতার কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে ঘরে থেকে ভালো থাকছি।
বিশ্বজগতে একমাত্র মানুষই পারে পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে। সহস্র প্রতিকূলতার মধ্যে তাই মানুষই টিকে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এ বছর আমরা নতুন মাত্রায় নববর্ষ উদযাপন করব। আমরা ঘরে থাকব আর একে অন্যের জন্য সহমর্মিতায় নিমগ্ন হব। আমরা আমাদের এই অনভ্যস্ত জীবনে বসে স্বপ্ন দেখব- একটা রোগহীন নতুন ভোরের। যেখানে মৃতের জন্য নীরবে কান্না নেই। যেখানে দিনখাটা মজুরের অন্ন জোগাতে না পেরে ঘরের কোণে ক্ষুধা নেই। যেই ভোরে মানুষেদের পরস্পরকে ছুঁতে না পারার কষ্ট নেই।
Advertisement
মানুষ কখনো পরাজয় মেনে নেয়নি। অনাদিকালের ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীতে কালে কালে, শতাব্দীতে শতাব্দীতে অনেক ধরনের বিপর্যয় এসেছে। কতশতবার মানবজাতি বিপাকে পড়েছে! কিন্তু কোনো কিছুই মানুষকে করতে পারেনি পরাভূত। যত জরা এসেছে, রোগ এসেছে, এসেছে মহামারি- মানুষ সেগুলো জয় করেছে। আমরা কিছুদিন ধৈর্য ধরে ঘরে আছি। আর কিছু মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে আবিষ্কার করে যাচ্ছে ভাইরাসবিরোধী ভ্যাকসিন। সেদিন হয়তো খুব দূরে না, আমাদের পেশী বিদীর্ণ করে শরীরে প্রবেশ করবে করোনার ভ্যাকসিন। আর আমরা হব করোনাব্যাধিমুক্ত। ততদিন পর্যন্ত শুধু নিজেরা নিজেদের কাছ থেকে দূরে থেকে অপেক্ষা করে যাওয়া।
প্রকৃতির সাথে মানুষের বিরোধ নেই কোনোকালে। আমরা ফিরে ফিরে প্রকৃতির সাথেই মিতালি করি। দিনের নিয়মে দিন যায়। বছর পেরুলে আবার ফিরে আসবে বৈশাখ আর সেদিন আমরা নিশ্চয়ই উৎসবে মেতে উঠব।
সে আমাদের ভালোবাসার আরেক বৈশাখ!
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ